টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হওয়া ফাইনাল শেষে লিওনেল মেসিকে নিয়ে যখন উদ্দাম আনন্দে মাতোয়ারা আর্জেন্টাইনরা, তখন মাঠের এক পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাঁর চোখ-মুখ আঁধার কালো। নিকষ কালো এই মুখাবয়ব দেখে কে বলবে তিনি মাত্রই হ্যাটট্রিক করে এসেছেন! আসলে দল জিতলে ব্যক্তিগত অর্জন-রেকর্ডকে তখন জঞ্জাল মনে হয়। তেমনি অবস্থা হয়েছে ২৪-এ পা দেওয়া ফরাসি এ তরুণের। আজ আবার তাঁর জন্মদিন। এত যন্ত্রণাময় জন্মদিন নিশ্চিতভাবেই আসেনি তাঁর জীবনে।
এমবাপ্পে কাতারে এসেছিলেন চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরে। তাঁর সে মুকুট ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন লিওনেল মেসি। তাই তো তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, রাজ্যহারা কপর্দকশূন্য এক সম্রাট। তাঁকে এতটা হতাশায় নিমজ্জিত হতে দেখে ভিভিআইপি গ্যালারি থেকে মাঠে নেমে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো। দেশের অন্যতম ফুটবল রত্নকে অভিভাবকের ন্যায় সান্ত্বনা দেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চেও ফ্রান্সের প্রতিটি খেলোয়াড়কে আলিঙ্গন করে প্রবোধ দেন প্রেসিডেন্ট। অবশ্য মুকুট হারানোর বেদনা কী কোনো সান্ত্বনায় উপশম হয়!
এমবাপ্পের চেয়ে দুঃখী মানুষ এই মুহূর্তে সম্ভবত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। রোববার রাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে সোনালি ট্রফির পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে তাঁর হেঁটে যাওয়া দেখে যে কারও হৃদয় ভেঙে যাবে। এমন দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বভাবতই গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি তিনি। তবে ফাইনাল শেষ হওয়ার ১৭ ঘণ্টা পর মুখ খুলেছেন এমবাপ্পে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রফির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ছবিটা দিয়ে তিনি লিখেছেন, 'আমরা ফিরে আসব।' মানে, মুকুট হারালেও হাল ছেড়ে দেননি তিনি। চার বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধারের ঘোষণা এখনই দিয়ে দিলেন!
চার বছর আগে রাশিয়ায় ৪ গোল করে ফ্রান্সকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন এমবাপ্পে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯। এবার তিনি অনেক পরিণত। এ ছাড়া বেনজেমা, পগবা, কন্তেসহ সেরা একাদশের ছয়জন ছিটকে যাওয়ায় তাঁর কাঁধে দায়িত্বও ছিল অনেক। সে দায়িত্ব বোধ থেকে হোক কিংবা মুকুট ধরে রাখার অদম্য বাসনা থেকেই হোক, কাতারে দুর্দান্ত খেলেন তিনি। ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের (১৯৬৬ বিশ্বকাপ) পর ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। এমনকি শিরোপা জেতা মেসিকেও গোলদাতার লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছেন। ৮ গোল করে মেসিকে টপকে (৭ গোল) হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু 'গোল্ডেন বুট' হাতে তাঁর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল সবকিছুই মূল্যহীন।
তবে এবার শিরোপা জিততে না পারলেও নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এমবাপ্পে। দুই বিশ্বকাপে তাঁর গোল সংখ্যা ১২টি। তাই ছলছল চোখে মাঠ ছাড়লেও দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনের বিশ্বফুটবল মঞ্চ শুধুই তাঁর। পেলের সঙ্গে কেন তাঁর তুলনা হয়, সেটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন এমবাপ্পে। পেলের মতো তরুণ বয়সে দুটি বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও দুটি ফাইনালে ঠিকই গোল করেছেন। ফাইনালে সর্বোচ্চ ৪ গোল করার রেকর্ডটি এখন তাঁর। আগামী বিশ্বকাপের সময় তাঁর বয়স হবে ২৭। নিশ্চিতভাবেই ক্যারিয়ারের সেরা ছন্দে থাকবেন। অবশ্য এখনই ফুটবল ইতিহাসে তিনি ছাপ রেখেছেন বলে মনে করছেন ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম, 'অনেকেই এবারের বিশ্বকাপে রেকর্ড গড়েছে। তবে কিলিয়ান অনন্য, এরই মধ্যে সে ইতিহাসে ছাপ রেখে গিয়েছে। এ বিশ্বকাপটা সে যেভাবে শেষ করতে চেয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। তাই এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরও শেষ পর্যন্ত হতাশ ছিল সে।' ফ্রান্সের অধিনায়ক হুগো লরিসও ভূয়সী প্রশংসা করেন তাঁর, 'এমবাপ্পে একটি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। ইতোমধ্যে সেরার ব্যাটন তার হাতে চলে গেছে।' ফ্রান্সের তরুণ দলটিকে নিয়েও ভীষণ আশাবাদী লরিস।
পিএসএন/এমঅাই
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত