বাইরের দুনিয়া থেকে ইরান সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত। কেউ একে কঠোর ধর্মীয় দেশ হিসেবে দেখেন, কেউবা মনে করেন এখানে নারী স্বাধীনতা দমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে ইরানের সামাজিক জীবন বহুস্তরীয়—যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার ছোঁয়া একসঙ্গে মিশে গেছে। এই বাস্তবতার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতিফলন হয় নারীদের পোশাকে।
ইরানে হিজাব সম্পর্কিত আইন
ইরানে হিজাব বা ইসলামি পোশাক আইন শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতির অংশ হিসেবে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সরকার নারীদের জন্য পোশাকবিধি নির্ধারণ করে, যার লক্ষ্য ছিল ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও সামাজিক শালীনতা রক্ষা। সাধারণত মানতু (লম্বা বোরকা), রুসারি (স্কার্ফ) এবং পা ও হাতের অংশ ঢেকে রাখা পোশাককে উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে সতর্কতা, জরিমানা বা কখনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ইরানের দণ্ডবিধিতে বলা আছে—যেসব নারী জনসমক্ষে ‘ইসলামি শালীন পোশাক ছাড়া’ উপস্থিত হবেন, তাদের ১০ দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানার দণ্ড দেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিধিতে আরও বলা হয়েছে, প্রথমে মৌখিক সতর্কবার্তা, পরে লিখিত সতর্কবার্তা এবং তৃতীয়বার অপরাধ পুনরাবৃত্তি হলে জরিমানা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
১৯৮৩ সালে দণ্ডবিধির ধারা ৬৩৮ এর মাধ্যমে নারীদের জন্য ‘উপযুক্ত হিজাব’ বাধ্যতামূলক হয়। সরকারি দপ্তর ও স্কুলে এটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে মানা হয়, তবে দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগ অনেকাংশে সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিনির্ভর।
বিপ্লবের আগে ও পরে পোশাকের বিবর্তন
ইরানে নারীদের পোশাকের ইতিহাস দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মতোই পরিবর্তনশীল। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগে রাজধানী তেহরানসহ বড় বড় শহরে অনেক নারী পশ্চিমা ধাঁচে পোশাক পরতেন—স্কার্ট, ব্লাউজ, হাই হিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে চুল খোলা রাখাও ছিল স্বাভাবিক বিষয়। সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পরেও ঘুরতে দেখা যেত তাদের।
কিন্তু বিপ্লবের পর সমাজে ধর্মীয় আদর্শ ও শালীনতা প্রধান হয়ে ওঠে। তবে সব নারী একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাননি। অনেকে চাদর ও কালো পোশাক গ্রহণ করেছেন ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে, আবার অনেকে বোরকা ও স্কার্ফ বেছে নিয়েছেন।
হিজাব আইন ও তার ব্যাখ্যা
ইরানে ‘বাধ্যতামূলক হিজাব আইন’ মূলত শালীন পোশাক পরিধান নিশ্চিত করতে তৈরি হয়। সংবিধানের ২১তম অনুচ্ছেদে নারীর মর্যাদা রক্ষা ও পরিবারের কেন্দ্রিকতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘Guidance Patrol’ বা ‘নৈতিকতা পুলিশ’ পোশাকবিধি পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০২২ সালে পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর আন্দোলনের ঢেউ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার মৃত্যুকে ঘিরে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগান ইরানি সমাজে নতুন এক প্রশ্ন তুলে দেয়—কতটা পোশাক রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে, আর কতটা হবে ব্যক্তিগত পছন্দ?
আন্দোলনের পর সমাজের পরিবর্তন
মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর এক বছর ধরে দেশজুড়ে যে আন্দোলন চলেছিল, তা ইরানের নারীদের পোশাকের ধারণায় এক নতুন যুগের সূচনা করে।
সরকার ২০২৩ সালে নতুন ‘Hijab and Chastity Bill’ পাস করে শালীনতা ভঙ্গের শাস্তি বাড়ালেও বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা দেখা যায়।
তেহরানের রাস্তায় এখন বহু নারী কোনো স্কার্ফ ছাড়াই চলাফেরা করেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে সম্পূর্ণভাবে হিজাব খুলে ফেলেন—পুলিশের তেমন তৎপরতাও এখন আগের মতো নেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের ফলে হিজাব ইস্যুটি নতুন রূপ নিয়েছে। অনেক তরুণ-তরুণী ও নারী এখন এই আইন পরিবর্তন বা সংস্কারের দাবি তুলছেন। তারা নিজেদের মতামত ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছেন—যা ইরানি সমাজে এক নতুন আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
তবে বাস, ট্রেন, মেট্রো ও বিপণিকেন্দ্রে এখনো অধিকাংশ নারীকে স্কার্ফ পরতে দেখা যায়। সমাজের একটি বড় অংশ এখনও মনে করে, হিজাব নারীর মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক।
হিজাব ব্যবহারে শৈথিল্যের কারণ
ইরানের ইসলামি প্রচার সংস্থার সহকারী প্রধান রুহুল্লাহ হারিজাভির মতে, দেশে হিজাব ব্যবহারে শৈথিল্য বা অনীহার পেছনে একাধিক কারণ একযোগে কাজ করছে। তার মতে, প্রথমত ধর্মীয় ও নৈতিক বিশ্বাসের দুর্বলতা এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রভাব তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হিজাব সম্পর্কে উদাসীনতা সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট ও বৈষম্য মানুষের মনোযোগকে নৈতিকতার পরিবর্তে জীবিকার দিকে সরিয়ে দিয়েছে, ফলে হিজাবের গুরুত্ব অনেকের কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত, হিজাব আইন বাস্তবায়নে অস্পষ্টতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দমনমূলক পদ্ধতির ব্যবহার জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। পাশাপাশি, কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে হিজাব ইস্যুকে ব্যবহার করছে, যা সমাজে বিভাজন ও অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে। হারিজাভি মনে করেন, এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব কেবল তখনই, যখন হিজাব প্রচারে জবরদস্তির বদলে শিক্ষা, সংলাপ ও সংস্কৃতিনির্ভর প্রণোদনা ব্যবহার করা হবে। তার মতে, রাষ্ট্রের উচিত নারীদের সহায়তা ও সুরক্ষায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে হিজাব শুধু বাধ্যবাধকতা নয়, বরং আত্মসম্মানের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদেশিনীর চোখে ইরানের হিজাব সংস্কৃতি
গ্রিক পর্যটক ড. সোফিয়া এ কুউতলাকি ১৯৮৯ সালে প্রথমবার ইরান সফর করেন। এই সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ‘Among the Iranians: A Guide to Iran’s Culture and Customs’- বইয়ে। ২০১০ সালে প্রকাশিত বইয়ে তিনি প্রথম সফরের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “তেহরানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতেই আমি অবাক হয়েছি। ভেবেছিলাম সব নারী একইরকম পোশাক পরেন। কিন্তু এখানে রঙ, নকশা আর ভিন্নতা দেখে বুঝলাম—হিজাবের মধ্যেও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ সম্ভব।”
একই বিষয়ে তিনি আরও লিখেছেন, “আমি তেহরানের উত্তরের ক্যাফেতে বসে দেখেছি, মেয়েরা হিজাব আলগাভাবে পরে, চুলের অর্ধেক অংশ বাইরে থাকে, রঙিন লিপস্টিক লাগায়। কেউ কেউ স্কার্ফ খোলার কাছাকাছি অবস্থায় থাকে, কিন্তু আশেপাশের কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।”
তবে তিনি লক্ষ্য করেছেন—মেট্রো স্টেশন, সরকারি ভবন বা মসজিদে প্রবেশের সময় সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিজাব ঠিক করে নেয়। “এ যেন এক সামাজিক সমঝোতা—কখন কীভাবে পরতে হবে, তা সবাই বুঝে গেছে।”
ইরানে পোশাক নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘সম্মান ও সামঞ্জস্য’। একজন নারী স্কার্ফ আলগা রাখলেও তার উদ্দেশ্য অনেক সময় ধর্ম অমান্য নয়; বরং এটি নিজেকে উপস্থাপনের এক সাংস্কৃতিক রূপ।
সোফিয়া বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, ইরানি নারীরা অনন্য সৌন্দর্যে তাদের ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে মিশিয়ে নিয়েছেন। রাস্তায় যে মেয়ে কালো চাদরে, সেও আত্মবিশ্বাসী; যে মেয়ে রঙিন বোরকাতে, সেও গর্বিত।”
হিজাব বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল
সম্প্রতি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছয়টি জাতীয় জরিপের সম্মিলিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইরানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী এখনও হিজাবকে ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারীদের প্রায় ৮৪ শতাংশ হিজাবকে ইসলামি বিধান হিসেবে স্বীকার করেছেন এবং ৮৬ শতাংশ হিজাবকে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান বলে মনে করেন। জরিপে আরও জানা যায়, দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি নারী জনসম্মুখে কোনো না কোনো ধরণের মাথা ঢাকার পোশাক ব্যবহার করেন—চাদর থেকে শুরু করে হালকা রুমাল বা স্কার্ফ পর্যন্ত।
এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে হিজাববিরোধী প্রবণতা যতটা প্রচার করা হচ্ছে, বাস্তবে ইরানি সমাজের বৃহত্তর অংশ এখনও এই ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি অনুগত রয়েছে।
ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক
ইরানে নারীর পোশাক শুধু কাপড় নয়; এটি তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম ও পরিচয়ের প্রতীক। আজকের ইরানি নারীরা সেই প্রতীকের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে, নিজের মতো করে ভারসাম্য তৈরি করছেন—যেখানে বিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা একসাথে থাকে। যদিও কিছু নারী হিজাব বা স্বার্ফ না পরেন, তবুও দেশের বেশিরভাগ নারী এখনও হিজাবের পক্ষে। ফলে ইরানি নারীর পোশাক হয়ে উঠেছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংলাপ, যা অতীত ও আধুনিকতা, শালীনতা ও স্বাধীনতা, আর ব্যক্তিগত চাহিদা ও সমাজের প্রত্যাশার মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করছে।
