চলতি জুন মাসের শেষে উদযাপন হবে মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এবারের ঈদে কোরবানির জন্য প্রায় সোয়া এক কোটি গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় চার লাখ বেশি। দেশি পশুতেই কোরবানির চাহিদা মেটাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। উৎপাদনের তথ্য অনুসারে এবারও ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা করা হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে প্রাথমিক হিসাবে এবছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ। তবে বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামী ১৪ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একটি সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
যে পরিমাণ কোরবানিযোগ্য পশু আছে অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমাদের দেশীয় পশুতেই কোরবানি হবে। ভারতীয় গরুর ওপর আমরা আর নির্ভর নই, আসবেও না। সীমান্ত দিয়ে গরু প্রবেশ করে আমাদের খামারিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বিজিবিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এমদাদুল হক তালুকদার, মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। যা আগের বছরের (২০২১) তুলনায় আট লাখ ৫৭ হাজার ৫২১টি বেশি। ২০২১ সালে সারাদেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, কোরবানি পশুর তথ্যটা এক কোটি ২৫ লাখের মতো বলছি আমাদের প্রাথমিক ধারণা হিসেবে। সামনে এ বিষয়ে বৈঠক আছে। তবে যে পরিমাণ কোরবানিযোগ্য পশু আছে অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমাদের দেশীয় পশুতেই কোরবানি হবে। ভারতীয় গরুর ওপর আমরা আর নির্ভর নই, আসবেও না। সীমান্ত দিয়ে গরু প্রবেশ করে আমাদের খামারিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বিজিবিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
মহাপরিচালক বলেন, কোরবানি নিয়ে আমাদের কর্মকর্তারা নানাভাবে কাজ করছেন। সামনে এ বিষয়ে বাজারের ভেটেরিনারি টিম থাকবে, আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, গত বছর কোরবানিযোগ্য পশু ছিল এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। অধিদফতরের প্রাথমিক হিসাবে এবার প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ পশুর মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি আট লাখ ৮৮ হাজার। আর বাকি প্রায় ১৬ লাখ ৪৩ হাজার গৃহপালিত পশু। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে আছে প্রায় সাত লাখ ৪৭ হাজার পশু, চট্টগ্রাম বিভাগে প্রায় ১৭ লাখ ৭৩ হাজার, রাজশাহী বিভাগে প্রায় ৪৪ লাখ ৭৮ হাজার, খুলনা বিভাগে প্রায় ১১ লাখ ৮২ হাজার, বরিশাল বিভাগে প্রায় চার লাখ ১১ হাজার, সিলেট বিভাগে প্রায় দুই লাখ ১২ হাজার, রংপুর বিভাগে প্রায় ১৫ লাখ ৫২ হাজার, ময়মনসিংহ বিভাগর প্রায় পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার পশু রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালে ২২ হাজার ৪৭০ জন কসাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আর ২০২২ সালে প্রায় ২৫ হাজার কসাইকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু জবাইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এবছর প্রশিক্ষিত কসাইয়ে সংখ্যাও বাড়বে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের মতে, এবার একটু বেশি কোরবানি হবে। কারণ নির্বাচনি বছর। তবে গবাদিপশুর অভাব হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন তিনি।
প্রাণিসম্পদের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা কোরবানির সকল তথ্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য তৈরি করছি, সামনে সভা আছে, এসব বিষয় চূড়ান্তের কাজ শেষ পর্যায়ে।
অধিদফতরের একাধিত তথ্যে জানা গেছে, এ বছর সবচেয়ে ভালো পশু উৎপাদন হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এই বিভাগের খামারির কাছ থেকে আসবে ৪৪ লাখ ৭৮ হাজারটি পশু। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান। এ বিভাগের খামারির কাছ থেকে আসবে ১৭ লাখ ৭৩ হাজার। এরপরে রয়েছে রংপুর বিভাগ। এবার এই বিভাগ থেকে ১৫ লাখ ৫২ হাজার পশু আসবে কোরবানির জন্য।
বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কারণে ২০১৬ সালে কোরবানির পশুর সংখ্যা প্রথমবারের মতো কোটি ছাড়িয়ে যায়। ২০১৫ সালে দেশে কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশুর সংখ্যা ছিল ৯৬ লাখ ৩৫ হাজার, যা ২০১৬ সালে দাঁড়ায় এক কোটি চার লাখের বেশি। ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০১৭ সালে এক কোটি চার লাখ কোরবানি হয়। ২০১৮ সালে এক কোটি ছয় লাখ এবং ২০১৯ সালে এক কোটি ছয় লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ওই বছর কোরবানি কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩। ২০২১ সালে দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ১৯ লাখ ১৭ হাজারে আর কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু। গতবার এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত থাকলেও কোরবানি হয় ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩টি গবাদিপশু।
এবছন কোরবানি বৃদ্ধি পেতে পারে মনে করছেন অনেকেই। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের মতে, এবার একটু বেশি কোরবানি হবে। কারণ নির্বাচনি বছর। তবে গবাদিপশুর অভাব হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন তিনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালে করোনার একটা বিষয় ছিল। যা গতবার ছিল না। গতবার কিন্তু কোরবানিও বেড়েছিল। আমরা মনে করি আমাদের পর্যাপ্ত পশু আছে, এবার কোরবানি এক কোটি ছাড়াতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, দেশে এখন স্বাস্থ্যসম্মত পশু উৎপাদনের জন্য বছরব্যাপী খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গত বছর অবিক্রিত থাকা পশুও এবারের কোরবানিতে যুক্ত হবে। ফলে এবার পশু সংকটের কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন একা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এই প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন বাড়াতে আমরা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা খামারিদের নিয়ে ব্যাপক কাজ করছে। সবমিলিয়ে প্রতিবছর কোরবানি পশুর সংখ্যা বাড়ছে।