সাকিবুর রহমান
চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা বিশেষ করে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের ভিসা সীমিত হওয়ায় খুলনার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে হঠাৎ বেড়ে গেছে রোগীর চাপ। তবে শুধু রোগীর সংখ্যা নয়, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেবার মানও। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এসেছে গুণগত উন্নয়ন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এখন আগের চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন রোগীদের, এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। চিকিৎসকদের আন্তরিকতা, সেবার স্বচ্ছতা ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থার উন্নয়ন—সব মিলিয়ে খুলনার স্বাস্থ্যখাতে তৈরি হয়েছে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা, যা এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রোগীদের জন্য নতুন ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে।
খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারের উপরে, যেখানে পূর্বে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০-১৫০০। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ১,০০০ শয্যার এই হাসপাতালে অনেকে ওয়ার্ড বা কেবিনে স্থান না পেয়ে বারান্দা বা সিঁড়ির নিচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবুও হাসপাতালটির চিকিৎসকরা নিয়মিত সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি জরুরি বিভাগেও এখন থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
পরিচ্ছন্নতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য উন্নতি। ওয়াশরুম ও ওয়ার্ডগুলো আগের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন। হাসপাতালের সামনে তৈরি হচ্ছে পাবলিক টয়লেট, এবং হাসপাতালের ভেতরে কম দামে ওষুধ বিক্রির জন্য ফার্মেসি স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ইউনিট।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, “খুলনা মেডিকেল এখন পদ্মার এপারে চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি রোল মডেল হতে পারে। প্রতিদিন আমাদের সক্ষমতার তিন-চার গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকেন, তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী এখানে আসেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্য পালন না করে কোন চিকিৎসকের অন্য হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ নেই। রোগীরা এখানে ভালো সেবা পাচ্ছেন পূর্বের তুলনায়। আর একারণে প্রতিদিন নিদ্রিষ্ট বেডের তুলনায় তিন থেকে চার গুন বেশি রুগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।”
খুলনা সদর হাসপাতালেও রোগীর চাপ বেড়েছে বহুগুণে। ২৫০ শয্যার এই সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতিদিন তিন হাজারেরও বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। ৫০০ বেডের বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন প্রতিদিন ভর্তি থাকেন প্রায় ১,০০০ রোগী। অনেকে স্থান সংকুলানের কারণে পুনরায় খুলনা মেডিকেলে পাঠানো হচ্ছেন। রোগীরা জানাচ্ছেন, অতীতের তুলনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ওষুধপ্রাপ্তি এবং চিকিৎসকদের ব্যবহার অনেক উন্নত হয়েছে।
রোগীদের অভিজ্ঞতাও বেশ ইতিবাচক। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মইনুল ইসলাম গাইন জানান, “সাত দিন আগে ভর্তি হয়েছি। একবার বড় ডাক্তার দেখে গেছেন, এরপর ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা সেবা দিচ্ছেন। আমি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছি।
যশোরের কেশবপুর থেকে জহিরুল ইসলাম মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এখানে চিকিৎসা করাতে, তিনি বলেন, “মেয়েকে ১২ দিন আগে ভর্তি করেছি। চিকিৎসকদের আন্তরিক সেবায় এখন সে সুস্থ।”
বটিয়াঘাটা উপজেলার মোহাম্মদ মিলন গাজী, যিনি পেটের পীড়া নিয়ে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, পেটের ব্যাথা নিয়ে দুদিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছি। চিকিৎসক এবং নার্সদের সেবায় মোটামুটি সুস্থ বোধ করছি। অতীতের তুলনায় সেবার মান এখন অনেক ভালো। এখন প্রায় ২৪ ঘন্টায় চিকিৎসকদের পাওয়া যায়। এখনকার সেবার মানে সত্যিই পরিবর্তন এসেছে। চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যবহার খুব ভালো লেগেছে।”
শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়, রোগীর চাপে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্রও পাল্টে গেছে। খুলনার সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা কেন্দ্র খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন ভর্তির পর কেবিন পাওয়া দুষ্কর। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার এখানেই। রোগীর ভিড়ে এ হাসপাতালের চার শতাধিক কেবিন পরিপূর্ণ থাকছে সর্বদাই। এ হাসপাতালে ভর্তি নগরের নিরালার বাসিন্দা জয়নব চৌধুরি, তিনি বলেন, চার দিন আগে পিত্ত থলিতে পাথর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা অপারেশন করিয়ে এখন পূর্ণ সুস্থ। তাদের সেবার মানে আমি সন্তুষ্ট।
চিকিৎসাব্যবস্থার এ পরিবর্তনের পেছনে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও রোগীদের দেশের প্রতি আস্থা ফিরে আসাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মোছাঃ মাহফুজা খাতুন বলেন, রোগীদের সেবা দিতে চিকিৎসক, নার্সসহ সকলেই আন্তরিক। তাছাড়া রোগীরা এখন আমাদের সেবায় ভরসা করছেন পূর্বের চেয়ে বেশি। সেবা দিতে সামান্য বিলম্ব হলে এখন আর দেশ ছেড়ে কেউ বিদেশ যেতে চায় না।
এ প্রসঙ্গে খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোঃ মনজুরুল মুরশিদ বলেন, খুলনা বিভাগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই রোগীদের সেবা দিতে এক প্রকার হিমসিম খেতে হচ্ছে। বিভাগের প্রায় সব হাসপাতালেই রোগীর চাপ এখন দ্বিগুণেরও বেশী। রোগী এবং তাদের স্বজনেরাও এখন চিকিৎসকদের সেবায় অনেক খুশি।
নাগরিক নেতৃবৃন্দও মনে করছেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফিরে আসা একটি ইতিবাচক দিক। খুলনার নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, “সেই একই চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। অথচ সেবা গ্রহণ করে সব রোগীরাই সন্তুষ্ট। চিকিৎসকরা সেবার মনোভাব নিয়ে সেবা দিলে মানুষ আর বিদেশ মুখী হবে না। আমাদের দেশে ভালো ভালো চিকিৎসক আছেন। কিন্তু আগে রোগীরা বিদেশে ছুটতেন, এখন আর যাচ্ছেন না। আন্তরিক সেবা দিলে মানুষ দেশেই চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হয়।”