আসছে ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে। শুধু তাদেরই নয়, দিতে হবে পরিবারের সদস্যদেরও সম্পদের হিসাব।এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এবারে যারা সম্পদের হিসাব দেবেন তাদের নামের তালিকা সংরক্ষণ করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারা আগামী পাঁচ বছর পর আবারও সম্পদের হিসাব দেবেন। আগামী বছর যারা সম্পদের হিসাব দেবেন তাদেরও তালিকা করা হবে। যথারীতি তারাও পাঁচ বছর পর আবার সম্পদের হিসাব দেবেন। প্রতি বছরই এ ধরনের তালিকা সংরক্ষণ করবে সরকার। ফলে সব সরকারি চাকুরে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবের আওতায় আনা হবে। এ জন্য বিদ্যমান ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হচ্ছে। স্পষ্ট করা হচ্ছে সম্পদের হিসাবদান পদ্ধতি। এতে চাপের মুখে পড়েছেন সরকারি চাকুরেরা।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার ডেডলাইন। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখব। এর পরই সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হবে। চাকরিতে প্রবেশের সময় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন তা ভিত্তি ধরে যাচাই-বাছাই করা হবে। এবার যারা হিসাব দেবেন তাদের তালিকা করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী তারা পাঁচ বছর পর আবার হিসাব জমা দেবেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবাইকে হিসাবের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে কাজ চলছে। ’
জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের তদারকি না থাকায় অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এ নিয়ম মানছেন না। এ অবস্থায় সরকারি চাকুরেদের (কর্মকর্তা-কর্মচারী) সম্পদের হিসাব নিতে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। ২৪ জুন সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে সম্পদের হিসাব দিতে চিঠি পাঠানো হয়।
এতে বলা হয়- ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর বিধি ১১, ১২ ও ১৩-তে সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রয় ও সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত বিধি কার্যকরভাবে কর্মকর্তাদের অনুসরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে জোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এ অবস্থায় ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর আওতাভুক্তদের তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/দফতর/অধীন সংস্থায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদ বিবরণী দাখিল, ওই সম্পদ বিবরণীর ডাটাবেজ তৈরি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও বিক্রির অনুমতি গ্রহণের বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ১১, ১২ ও ১৩ বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয় চিঠিতে। এর পরই নড়েচড়ে বসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। তারাও যথারীতি তাদের অধীন দফতর-সংস্থাকে চিঠি দেয় সম্পদের হিসাব দিতে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১১ জুলাই, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ১৪ জুলাই, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২৮ জুলাই, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ১৮ আগস্ট, ভূমি মন্ত্রণালয় ২৫ আগস্ট, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ ২০ সেপ্টেম্বর নিজ দফতর ও সংস্থাগুলোকে সম্পদের হিসাব দিতে চিঠি পাঠিয়েছে। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দিয়েছে।
এতে বড় ধরনের চাপে পড়েছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। কারণ বিদ্যমান বিধিমালা কার্যকর হলে শুধু সরকারি চাকুরে নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও সম্পদের হিসাব দিতে হবে। বিধিমালার বিধি-২ (সংজ্ঞা) অনুযায়ী ‘সরকারি কর্মচারী অর্থ ওই ব্যক্তি বা যার ক্ষেত্রে এ বিধিমালা প্রযোজ্য এবং “সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্য”-এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। ’ সংজ্ঞায় সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্য বলতে ‘সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে বসবাস করেন অথবা না করেন, তার স্ত্রী/স্বামী, সন্তান বা সৎ সন্তানগণ এবং সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে বসবাসরত এবং তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল তার নিজের অথবা স্ত্রীর/স্বামীর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন’কে বোঝাবে। ফলে শুধু চাকরিজীবীর সম্পদের হিসাব দিলেই হবে না, দিতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সম্পদের হিসাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের নামে সম্পদ না করে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের নামে করে থাকেন। কেউ কেউ নিজের ভাই-বোন বাদ দিয়ে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামে সম্পদ করেন। এসব হিসাব নেওয়া শুরু হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তাই দুষ্টচক্রের চাতুরী চলতে থাকবে। এ কারণেই গত ৪০ বছরেও এ বিধিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘৪০ বছর আগের বিধিমালা যুগোপযোগী করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ নিয়ে একটি কর্মশালাও হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোথায় কোনো গ্যাপ আছে কি না খোঁজা হচ্ছে। কিছু সুপারিশ পাওয়া গেছে। আরও হয়তো সময় লাগবে। ’
এর আগে একাধিক অনুষ্ঠানে সম্পদের হিসাবে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পদের বিবরণী দাখিলের নিয়ম আছে। এত দিন সেভাবে হয়তো মানা হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আর ছাড় দেব না। ’ ৭ সেপ্টেম্বর বিএসআরএফ সংলাপে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও সম্পদের হিসাব দেওয়া উচিত কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। স্বচ্ছতা-জবাবদিহির জন্য আমরা সবাই সম্পদের হিসাব দেব। ’
সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন