চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি বৃহৎ প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র মোংলা বন্দরের চেহারা আমূল বদলে যাবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মোংলা বন্দর একটি আঞ্চলিক হাবে পরিণত হবে।
‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গত ২’রা ফেব্রুয়ারী একনেক কতৃক অনুমোদিত হয় এবং জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য মোংলা বন্দর কতৃপক্ষ এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন কর্পোরেশন (CCECC) এর মধ্যে গত ২৫শে মার্চ তারিখে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় গত দুই বছর ধরে আমদানি-রপ্তানিকারকদের মাঝে মোংলা বন্দরের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। তবে, জেটি সংকট, আধুনিক অবকাঠামোর অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতা দূর করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পটির বাস্তবায়নের জন্য ডিসেম্বর ২০২৮ সালের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪,০৬৮ কোটি ২২ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা, যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪৭৫ কোটি ৩২ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা এবং বাকি ৩,৫৯২ কোটি ৮৯ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা টাকা দেবে চীন সরকার ঋণ হিসেবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা প্রধান মোঃ জহিরুল হক জানান, এই প্রকল্পের আওতায় মোংলায় নির্মিত হবে দুটি ৩৬৮ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জেটি, একটি আধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল, ডেলিভারি ইয়ার্ড, বহুতল কার ইয়ার্ড, ডুবন্ত রেক অপসারণ ব্যবস্থা, প্রধান সড়ক উন্নয়ন এবং শিট পাইলিংসহ বিভিন্ন ৮৭৬০০ বর্গমিটার লোড কন্টেইনার ইয়ার্ড, ৩৪১৭০ বর্গমিটার খালি কন্টেইনার ইয়ার্ড, ৪২৬০ বর্গমিটার বিপদজনক কার্গো হ্যান্ডেলিং ইয়ার্ড ক্রয় করা হবে। কার্গো হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি ও অটোমেটেড অপারেশন সিস্টেম স্থাপন করা হবে, যা হবে বাংলাদেশে প্রথম মনুষ্যবিহীন আধুনিক ক্রেনের মাধ্যমে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্দরের বার্ষিক কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১.৫ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হবে এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১.৫ লাখ টিইইউএস থেকে বেড়ে ৪ লাখ টিইইউএসএতে পৌঁছাবে। এর ফলে বন্দরটির কার্যকারিতা, সক্ষমতা এবং আঞ্চলিক গুরুত্ব বহুগুণে বাড়বে। সময় সাশ্রয় হবে, দক্ষতা বাড়বে এবং আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি আসবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, চীনের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক মোঃ সামিউল হক বলেন, “এই বিনিয়োগ শুধু অবকাঠামো নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সক্ষমতার অংশ। এতে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। একইসঙ্গে কৌশলগত অবস্থান সুসংহত হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে আধুনিক বাণিজ্যিক অবকাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, যা দেশীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে।” ফলে মোংলা বন্দর এক সময় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হবে।
মোংলা পোর্ট চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহিন রহমান বলেন, “মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন” (Expansion and Modernization of Mongla Port Facilities) শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে মোংলা বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি অটোমেটে্ট বন্দরে রুপান্তরিত হবে। ফলে বিডার (বিডা পূর্ণরূপ) পরিকল্পনা অনুযায়ী অটোমেটেট সিস্টেম বাস্তবায়নের ফলে বিনিয়োগ সহজীকরণে ভূমিকা রাখবে।
মোংলা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন মোংলা পোর্ট বার্থ অ্যান্ড শিপ-অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সায়েদ জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “মোংলা সমুদ্রবন্দর অতীতে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে বর্তমানে এটি একটি আধুনিক ও লাভজনক বন্দরে পরিণত হয়েছে’’।
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে পশুর নদীর পূর্ব তীরে ১৯৫০ সালে স্থাপিত মোংলা বন্দরে বর্তমানে পাঁচটি জেটিতে ২২টি নোঙর পয়েন্টে একসঙ্গে ৪৭টি জাহাজ ভিড়তে পারে। প্রকল্পটির উন্নয়ন কাজ শেষ হলে এই সক্ষমতা বহুগুণে বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।