দিন-মাস বা বছর নয়, প্রায় দেড় যুগ ধরে জাল রুপির ব্যবসা করতো একটি পরিবার। পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে জাল রুপি এনে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করা হতো। ধীরে ধীরে পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয় এই অবৈধ কারবার। বড় ভাই ফজলুর রহমান ফরিদ পাকিস্তান থেকে জাল রুপির চালান পাঠাতেন বাংলাদেশে। দেশে থাকা অপর দুই ভাই সাইদুর রহমান ও নোমানুর রহমান এবং তাদের বোন জামাই শফিকুর এসব নোট বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাঠাতেন। ঢাকায় বসে কাপড়ের ব্যবসার আড়ালে পুরো টাকা-পয়সার লেনদেন করতেন সাইদুর। তার তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একবছরেই কয়েক কোটি টাকার লেনদেন পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (গুলশান) মশিউর রহমান জানান, পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে জাল রুপির কারবার করে আসছিল। কাপড়সহ আমদানি-রফতানির বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে জাল রুপি নিয়েই ছিল তাদের মূল কারবার। চক্রটির বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখনও কয়েকজন পলাতক আছে। তাদের গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বরে খিলক্ষেত থানা পুলিশ ৭ কোটি ৩৫ লাখ জাল রুপিসহ আবু তালেব ও ফাতেমা নামে দুই জনকে গ্রেফতারের পর মামলা করে। এটি তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের সদস্যরা তদন্ত করতে গিয়ে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেটের সন্ধান পায়।
আবু তালেব ও ফাতেমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার ভাই নোমানুর রহমান ও ভগ্নিপতি শফিকুর পালিয়ে আত্মগোপন করে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি গোপন খবরের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে নোমানুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হাজারীবাগ এলাকা থেকে সুনামগঞ্জের জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কার্যালয়ের গাড়িচালক আমান উল্লাহ ভূঁইয়া, তার দ্বিতীয় স্ত্রী কাজল রেখা এবং কাজল রেখার ভাই ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামতকে গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটি পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে ভারতীয় জাল রুপি তৈরি করে বিভিন্ন পণ্য আমদানির নামে বাংলাদেশে আনছিল। এরপর তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করছিল। চক্রটির মূল হোতা পাকিস্তানি নাগরিক শাফি ও সুলতান। তাদের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাসিন্দা ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদের পরিচয় হওয়ার পর প্রায় দেড় যুগ আগে ফজলু এই কারবার শুরু করে। একে একে ফজলু দেশে থাকা তার ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের এই কারবারে যুক্ত করে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফজলুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা আগে পাকিস্তানে থাকলেও পরিবারের অপর সদস্যরা বাংলাদেশে চলে আসে। কিন্তু ফজলু পাকিস্তানেই থেকে যায়। সেখানকার নাগরিকত্বও নিয়েছে সে। বছর চারেক আগে একবার দেশে এসেছিল সে। দেশে তার ভাই সাইদুর পুরো কারবার দেখাশোনা করে। তদন্তের অংশ হিসেবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাইদুরের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের তিনটি হিসাবের নথিপত্র ঘেঁটে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে।
জানা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের গেন্ডারিয়া শাখায় সাইদুরের একটি হিসাবে গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ১ কোটি ৯৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৫১ টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার অপর একটি হিসাবে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৯৬২ টাকা লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার আরেকটি হিসাবে ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৬ টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
একবছরের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার, বিনোদপুর ও গোমস্তাপুর এলাকা থেকে ইয়াসির নামে এক ব্যক্তি চার দফায় সাইদুরের ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে ১৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। এছাড়া আয়নাল নামে আরেক ব্যক্তি একই এলাকা থেকে ১৭ দফায় ৫০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। নাদিম নামে এক ব্যক্তি চার দফায় ৮ লাখ, আতাউর নামে এক ব্যক্তি দুই দফায় আড়াই লাখ, সুজন ৫ লাখ ও আরাফাত দুই লাখ টাকা জমা দিয়েছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার, বিনোদপুর ও গোমস্তাপুর থেকে যারা সাইদুরের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিয়েছেন, তারা সবাই এই জাল রুপি চক্রের সদস্য। তারা প্রতি লাখ জাল রুপির বিনিময়ে সাইদুরকে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিতেন। সেই হিসাবে এই চক্র কোটি কোটি জাল রুপি ভারতে পাচার করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইয়াসির নামে কানসাট থেকে যে ব্যক্তি সাইদুরের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিতেন তাকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। সে এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য আমান উল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রী কাজল রেখার ভাই। ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামত গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম হারুনুর রশিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামত জানিয়েছে, সে ঢাকায় আগে ফেরিওয়ালা হিসেবে কাজ করতো। বাদামতলী রোডের চায়না মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী সাইদুরের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে জাল রুপির কারবারে জড়িয়ে পড়ে সে। সাইদুর তাকে কাপড়ের চালানের মধ্যে জাল রুপির টাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে বলতো। প্রতি চালান পৌঁছে দিলে ১০ হাজার করে টাকা পেত সে।
ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামত জবানবন্দিতে আরও জানায়, সে বিভিন্ন সময়ে জাল রুপির চালান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানাধীন আজতপুর দিয়ারহুদা গ্রামের হাবিল নামে এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিয়েছে। একইসঙ্গে হাবিল ও আইনালের কাছ থেকে বাংলা টাকা নিয়ে সাইদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরমাতের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার ৬ নং চৌডালা ইউনিয়নের মেনিচক এলাকায়। আয়নাল নামে যে ব্যক্তির কাছে সে জাল রুপির চালান পৌঁছে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে তিনি তার আপন চাচা। আর নাদিম নামে যে ব্যক্তি সাইদুরের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিয়েছে সে আয়নালের ছেলে। এছাড়া আতাউর, আরাফাত ও সুজন ওই সিন্ডিকেটের সদস্য। তাদের বাড়িও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়।
ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরমাতের বোন কাজল রেখাও গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম তামান্না ফারাহ’র আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। কাজল রেখা জানিয়েছে, আমান উল্লাহর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে তার সঙ্গে জাল রুপি সিন্ডিকেটের মূল হোতা পাকিস্তানে অবস্থানরত ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদ, তার ভাই সাইদুর রহমান ও নোমান রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমে সে মাসে দুই-তিন বার করে জাল রুপি চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতো।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে জাল রুপির কারবারের পুরো নিয়ন্ত্রণ করতো মূল ফজলুর রহমানের পরিবার। তাদের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাজল রেখা-কেরামতের পরিবার জাল রুপি বিভিন্ন কৌশলে ভারতে পাচারের দায়িত্ব পালন করতো। কাজল রেখা, তার ভাই ইয়াসির আরফাত ওরফে কেরামত, বোন শারমিন, ভগ্নিপতি সোনা মিয়া, চাচা আয়নাল, চাচাতো ভাই নাদিম, ভাগ্নে ফিরোজ ও কিবরিয়া, ভাতিজা নেলসনসহ পুরো পরিবারের সদস্যরাই এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গুলশান) কামরুজ্জামান সরদার বলেন, ‘চক্রটির আরও বেশ কয়েকজন সদস্য পলাতক। তাদের গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে ফজলুর, সাইদুর, নোমানরা জাল রুপির কারবার করে কী পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছে তাও জানার চেষ্টা চলছে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনেও মামলা করার সুপারিশ করা হবে।
পাকিস্তান থেকে যেভাবে আসে জাল রুপি
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, আগে উড়োজাহাজে করে পাকিস্তান থেকে জাল রুপি আনা হতো দেশে। কিন্তু বিমানবন্দরের কড়াকড়ির কারণে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে এই চক্র। চক্রটি বিভিন্ন পণ্য বিশেষ করে কাপড় ও পাথর বা অন্যান্য সামগ্রী আমদানির নামে সমুদ্র পথে জাল রুপি আনা শুরু করে। সাগর পথে বিভিন্ন পণ্যের কনটেইনারে তা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে দেশে আনে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম পোর্টে একদিনে হাজার হাজার কনটেইনার খালাস করা হয়। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষেরও কোন কনটেইনারে জাল রুপি আছে তা ধরার কোনও উপায় নেই। তবে বন্দরের স্ক্যানিংসহ আরও বেশি নজরদারি বাড়ানো হলে জাল রুপি আনা বন্ধ করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে আসা কনটেইনারগুলোতে বেশি নজরদারি করা প্রয়োজন।
যেভাবে ভারতে পাচার হয়
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থলবন্দরসহ সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙ্গিয়ে রাতের আঁধারে এসব জাল নোট ভারতে পাচার করা হয়। এছাড়া সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের ভারতীয় পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকচালকদের মাধ্যমেও এই জাল নোট ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা জাল নোটের বিনিময়ে ভারত থেকে মাদক ও অবৈধ অস্ত্রও কিনে থাকে।
পিএসএন/এমঅাই