ঈদের পর বাজারে চাহিদা বেড়েছে ডিমের। সপ্তাহের ব্যবধানে ডজন প্রতি দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। ফলে খোলা বাজারে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন— চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ কম। এজন্য দাম খানিকটা বেড়েছে।
তবে বাড়তি দামের জন্য প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ বিভিন্ন ডিম ব্যবসায়ী সমিতির বিরুদ্ধে। বলছেন, বাজারের বাড়তি দামের সুফল পাচ্ছেন না তারা। বরং অনেক খামারির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের।
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাজারের ডিম ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাড়ছে ডিমের দাম। বরং তারাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসানে ডিম বিক্রি করেন।
বাজারের চিত্র কী?
গতকাল, অর্থাৎ রোববার বাজারে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হতে দেখা গেছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। এ নিয়ে কথা হয় ক্রেতাদের সঙ্গে। তাদের অভিযোগ— সপ্তাহের বিভিন্ন সময় দফায় দফায় ডিমের দাম বেড়েছে। যেখানে গেল সপ্তাহে ডিমের দাম ছিল ১২০ টাকা। সেখানে এখন কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
হাসিফ হোসেন খান একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। মিরপুর-১১ নম্বরের বাজারে এসেছেন তিনি। ডিমের বাড়তি দামের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, রাতে এক ডজন ডিম কিনলাম ১৫০ টাকায়। অথচ তিন দিন আগেও ১৩০ টাকায় কিনছি। যেটা ১২০ টাকা ডজন ছিল, এক সপ্তাহ আগে।
তার অভিযোগ, মুরগি বা মুরগির খাবারে কি এমন সর্বনাশ হচ্ছে যাতে পাঁচ-ছয়দিনেই দামে এত ব্যবধান হয়? এগুলো ডিম ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
মিরপুর বাজারের ডিম বিক্রেতারা বলছেন, তাদেরও বাড়তি দামে কিনতে হয়। ফলে লাভ রেখে বিক্রি করতে গেলে দাম আরেকটু বাড়াতে হয়।
আজগর আলী নামে একজন খুচরা ডিম বিক্রেতা বলেন, আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে দামে ডিম কিনি; তার সঙ্গে বাড়তি কিছু হিসাব যোগ করেই ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে হয়। অর্থাৎ খুব বেশি না হলেও লাভের অংশ হিসাব করে আমরা বিক্রি করি। আমরা দাম বাড়াইতে পারি না।
খামারিদের অভিযোগ
খামারিরা জানিয়েছেন— দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা ৪ কোটি। কিন্তু উৎপাদন হয় সাড়ে ৪ কোটি। সাড়ে ৫ কোটি মুরগি থেকে এই ডিম উৎপাদন হয়। বাজারে যে ডিমের চাহিদা রয়েছে তার ৮০ শতাংশই উৎপাদন করছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা।
সুমন হাওলাদার বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি বলেন, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান বা সহযোগিতা না থাকায় প্রান্তিক খামারিরা ডিমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। ফলে দিন দিন খামারির সংখ্যা কমছে। মূলত ডিমের বাজারের সিন্ডিকেটই দাম নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি অভিযোগ করেন— তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও করপোরেট কয়েকটা প্রতিষ্ঠান আছে। তারা চাইলে দাম বাড়িয়ে দিতে পারে, আবার কমাতেও পারে। ১ মে খামারে যে লাল ডিমের দাম ছিল ৮ টাকা ২০ পয়সা, ২ মে থেকে ১১ মে পর্যন্ত সেই দাম ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু কী এমন পরিবর্তন হয়েছে যার জন্য ডিমের এতো দাম বাড়াবে?
খামারিরা বলছেন, খামারে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ টাকা। কিন্তু তাদের কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, তারা ডিম উৎপাদন করলেও দাম নির্ধারণ করে তেজগাঁও ডিম সমিতি ও কয়েকটা করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি খামারিদের কাছ থেকে ডিম কেনার পর ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীদের বিক্রির জন্য বেশি দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে বাজার থেকে ক্রেতা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
সুমন হাওলাদারের দাবি— এই মুহূর্তে কোনো ধরনের পরিবর্তিত পরিস্থিতি না থাকলেও ডিম ব্যবসায়ীদের কারণেই ভোক্তা পর্যায়ে ডিমের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এখন সরকার খুচরা মূল্য ১২ টাকা বা সাড়ে ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে; তা যৌক্তিক মূল্য। কিন্তু এটা থাকে না তখন ডিম ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে এটার দাম কমিয়ে ফেলেন। খামারিদের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা হলেও বিক্রি করতে হয় সাড়ে ৭ টাকা থেকে ৮ টাকার ভেতরে। প্রান্তিক খামারিরা তাদের কাছে অসহায়।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?
প্রান্তিক খামারি ও পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের অভিযোগ নাকচ করেছে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। নেতাদের দাবি— রমজানে ডিমের দাম সবসময় কম থাকে। কারণ চাহিদা কম থাকে। কিন্তু এরপর এ বছর প্রচণ্ড গরমের কারণে অনেক মুরগি মারা যাওয়ায় দাম বাড়ছে ডিমের। গরমের কারণে ডিমের উৎপাদনও কমে গেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। আড়তদাররা ডিমের দাম বাড়াতে পারে না। সুযোগ নেই।
আমান উল্লাহ তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। তিনি বলেন, গতমাসের গরমে লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। ডিমের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এখন চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কম, তাই দাম বাড়ছে। তবে এভাবে দাম বাড়ার জন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দায়ী করেছেন এই ব্যবসায়ী।
আমান উল্লাহ বলেন, যারা প্রত্যন্ত খামারি তারা মিডিয়াকে (মধ্যস্বত্ত্ব ব্যবসায়ী) ডিম দেয়। আমরা মিডিয়া বা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছ থেকে ডিম কিনি। স্থানীয় পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্ত্বভোগী তারাই দাম বাড়ায়। আমি কালকে ১ হাজার ১৩০ টাকা দিয়ে যেই ডিম কিনছি; সেটা রাতে হোলসেল পর্যায়ে ১ হাজার ১১০ টাকায় বিক্রি করেছি। বরং আমার ২০ টাকা লোকসান হয়েছে। তাহলে আমরা কীভাবে দাম বাড়াই, দেশের কোনো আড়তদার ডিমের দাম বাড়াতে পারে না। চাহিদা থাকলে বাজারে দাম বাড়ে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড তাপদাহে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ মুরগি মারা গেছে। যার আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকা।
তবে এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদারের দাবি— এপ্রিল মাসে যেসব মুরগি মারা গেছে; তার জন্যই ১ মে থেকে ১২ মে, অর্থাৎ কাল পর্যন্ত ডিমের দাম বেড়েছে; এটা বলা যাবে না। কারণ চারদিন পরপর ডিম ব্যবসায়ীরা খামারিদের থেকে ডিম কেনেন। ফলে ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দফায় দফায় দাম তারা নিজেদের স্বার্থে বাড়িয়েছে।
হিমাগারে ডিম মজুত!
হিমাগারে ডিম সংরক্ষণ করে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রান্তিক খামারিরা। তাদের কথার কিছুটা সত্যতা মেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের গেল সপ্তাহের অভিযানে।
ওই অভিযানে মজুত করা ডিমের বড় দুটি চালান পেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। কর্মকর্তারা বলছেন— নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গায় ডিম মজুতের অভিযোগ ছিল। সেই ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়াতে একটি হিমাগারে থাকা ২৮ লাখ ডিম জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া নরসিংদীতে একটি হিমাগার থেকে ২০ লাখ ডিম জব্দ করা হয়েছে।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, সাধারণত ডিম হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায় না। অসৎ উদ্দেশ্যই এটা করা হয়। ডিম মজুতের মূল উদ্দেশ্য— বাজারে সাপ্লাই কমার পর তা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা। এতো পরিমাণ ডিম মজুত করাই হয়েছে এই উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে মজুতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে বিদ্যমান আইনে ডিম হিমাগারে সংরক্ষণ করা হলে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
সফিকুজ্জামান জানান, বাজারে পণ্য সরবরাহ ধরে রাখার জন্য চালানো হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযান চালিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। কুমিল্লায় অভিযানের খবর পেয়ে সতর্ক হয়ে হিমাগারের ডিম সরিয়ে ফেলেছে বা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।
তিনি জানান, অভিযানের পর এসব ডিম বাজারে বিক্রির জন্য ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে বাজারে ডিমের সরবরাহ ঠিক থাকে। স্থানীয় প্রশাসন ও অনেক সময় ব্যবস্থা নেয়। তবে বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। সূত্র: বিবিসি