জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে অংশ নিয়েছে বিএনপি। এই আলোচনায় দলটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের অনড় অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রথমত, একই ব্যক্তি একযোগে সরকারপ্রধান, দলপ্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না—এই প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। দ্বিতীয়ত, কেউ টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এই প্রস্তাবেও তারা একমত নয়। তবে বিএনপি জানিয়েছে, কেউ যদি টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে এক বছর বিরতির পর আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
এর আগে, রোববার (২০ এপ্রিল) বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সংসদের এলডি কক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় অনেক গণতান্ত্রিক দেশে দলপ্রধানই সরকারপ্রধান হয়ে থাকেন, যেমন— যুক্তরাজ্যে। তাই এই বিষয়টিকে গণতন্ত্রবিরোধী বলা যাবে না। তবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জনগণের রায়েই ঠিক হবে কে সরকার গঠন করবে।
বিএনপি রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে তারা মনে করে, সবকিছু সংবিধানে ঢোকানোর বদলে নতুন আইন করে বাস্তবায়ন করাই ভালো হবে। কারণ ভবিষ্যতে পরিবর্তন দরকার হলে সংবিধান সংশোধন কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গঠনের বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবেও বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে। দলটির মতে—এমন কাউন্সিল গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমস্যায় পড়তে হবে। এছাড়া বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। তবে তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার এই তিনটি মূলনীতি সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
বিএনপি সংবিধানে ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে। তবে তাদের মতে, রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা ও বাস্তবতা বিবেচনা করে মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করা উচিত। সংসদ সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দলটি চারটি বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। চারটি বিষয় হলো— অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী এবং জাতীয় নিরাপত্তা। এসব বিষয়ে এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন, তবে অন্যান্য বিষয়ে স্বাধীন মত দিতে পারবেন।
নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার প্রস্তাবে বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও স্বশাসিত করার বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তারা মনে করে, এসব বিষয়ে সংবিধানে না রেখে আইন করে বাস্তবায়ন করা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ সব স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও তারা বলেছে।
বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছে। তারা চায় এই বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হোক। এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন নিয়ে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে, চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদে বাকি সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা যেন স্বাধীনভাবে ভোট ও মত দিতে পারেন। এসব চারটি বিষয় অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী ও জাতীয় নিরাপত্তা।
রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয়। তারা বলেছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি ৫৪ বছর ধরে জনগণ ব্যবহার করে আসছে। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাম, যার অর্থ জনগণের শাসনব্যবস্থা। এটি কোনো রাজতন্ত্রবিরোধী শব্দ নয়। বরং জনগণের প্রতিনিধিরাই সংসদে এসে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং আইন তৈরি করেন—এটাই গণতান্ত্রিক রীতি।
বিএনপি জানিয়েছে, তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগকে গুরুত্বসহকারে দেখছে এবং আন্তরিকভাবে আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। এর আগে বৃহস্পতিবার প্রথম দফা বৈঠকে সংবিধানের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার ও আইনসভা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগসহ পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন ব্যবস্থার কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা এখনও বাকি আছে, যা আগামী বৈঠকে শেষ হবে।
রোববারের বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও আবু মো. মনিরুজ্জামান খান। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সঞ্চালনায় ছিলেন মনির হায়দার এবং উপস্থিত ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও সফর রাজ হোসেন।
বৈঠক শেষে জানানো হয়, আগামী মঙ্গলবার আবারও আলোচনা বসবে বিএনপি ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে। আশা করা হচ্ছে, সেদিনই বিচার বিভাগসহ সব বিষয়ের আলোচনার সমাপ্তি টানা যাবে।