দুর্নীতিবাজদের কঠোর নজরদারিতে আনতে এবং তাদের গোপন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়টি আরও গতিশীল করতে বিদ্যমান গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মালয়েশিয়া, হংকং ও ভারতের মতো উন্নত দেশের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর আদলে সাজানো হবে এ ইউনিটকে।
দুদকের গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে ইতোমধ্যে শক্তিশালী ‘গোয়েন্দা অনুবিভাগ’ সৃষ্টিসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহাপরিচালকের অধীনে পূর্ণাঙ্গ অনুবিভাগে দুজন পরিচালক ও পাঁচজন উপপরিচালকসহ শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে।
দুদকের আট বিভাগীয় ও ৩৬ জেলা কার্যালয়ে থাকবে গোয়েন্দা অনুবিভাগের বিচরণ। সঙ্গে থাকবে উন্নতর প্রশিক্ষণ ও অত্যাধুনিক গোয়েন্দা যন্ত্রপাতির সুবিধা। গত ১৮ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে কমিশন বৈঠকে এসব প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে অনুমোদন দেওয়া হয় বলে ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর বক্তব্যেও। তিনি বলেন, দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোতে গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। সেই গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি (দুদক চেয়ারম্যান) গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, দুদক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে কমিশন বৈঠকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোতে ছয়জন কর্মকর্তা ও চারজন কর্মচারীসহ ১০ জনের জনবল রয়েছে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোতে শুধুমাত্র প্রধান কার্যালয়ের জন্য জনবল রাখা হয়েছে। কমিশন বৈঠকে তা বাড়িয়ে বিভাগীয় ও জেলা অফিসসহ শতাধিক জনবল নিয়ে শক্তিশালী ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত এসেছে। একইসঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকছে।
কমিশন বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহ:
পৃথিবীর উন্নত সব দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, দক্ষ ও শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। মালয়েশিয়ায় এমএসিসি, হংকংয়ে আইসিএসি, ভারতের সিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ও শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। এসব দেশে প্রতিটি অনুসন্ধান শুরু হয় তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিটের বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে গোয়েন্দা ইউনিট সংক্রান্ত পাঁচটি প্রস্তাব কমিশনে ওঠে। এসব প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়।
প্রস্তাবগুলো হলো:
>> বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোতে ছয়জন কর্মকর্তা ও চারজন কর্মচারীসহ ১০ জনের জনবল বাড়িয়ে যৌক্তিক জনবল নতুন সাংগঠনিক কাঠামোয় যুক্ত করা।
>> বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোতে শুধুমাত্র প্রধান কার্যালয়ের জন্য জনবল রাখা হয়েছে, যা যৌক্তিক নয়। জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ে জনবল থাকা প্রয়োজন।
>> কমিশনের বর্তমান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গোয়েন্দা কাজের পাশাপাশি অনুসন্ধান, তদন্ত, এনফোর্সমেন্ট, প্রসিকিউশন, প্রতিরোধসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। ফলে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক গুণগত মানসম্পন্ন প্রতিবেদন পাওয়া যায় না।
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রধান কার্যালয়সহ জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য পৃথক কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা, যারা শুধু গোয়েন্দা ইউনিটে কাজ করবেন। গোয়েন্দা কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করবেন না তারা।
>> গোয়েন্দা ইউনিটকে একজন মহাপরিচালকের অধীন পূর্ণাঙ্গ অনুবিভাগে রূপ দেওয়া হবে। মহাপরিচালকের অধীন দুজন পরিচালক থাকবেন, যার একজন প্রধান কার্যালয় এবং আরেকজন জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয় দেখবেন। এছাড়া পরিচালকদের অধীনে পর্যাপ্ত জনবল থাকা আবশ্যক। টিমভিত্তিক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবল সাংগঠনিক কাঠামোতে রেখে পদায়ন করা যেতে পারে।
>> পরিচালকের (প্রধান কার্যালয় ডেস্ক) অধীন পাঁচটি টিম থাকবে। প্রতিটি টিমে একজন উপ-পরিচালক, দুইজন সহকারী পরিচালক ও দুইজন উপসহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে ২৫ জন কর্মকর্তা থাকবেন। পাঁচটি টিমের সঙ্গে ১০ জন কনস্টেবল ও পাঁচজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর থাকবেন।
>> এছাড়া পরিচালক, জেলা কার্যালয়ের অধীন আট বিভাগে আটজন ও ৩৬ জেলা কার্যালয়ে ৩৬ জনসহ মোট ৪৪ জন সহকারী পরিচালক পদ সৃষ্টি করা। পুলিশ বিভাগের গোয়েন্দা শাখাসহ অন্যান্য সংস্থার আদলে পরিচালকদের দাপ্তরিক কাজের জন্য অন্যান্য জনবল রাখা।
অন্যদিকে, দক্ষ ও কার্যকর গোয়েন্দা ইউনিট গঠনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৌলিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেখানে দেশের অন্যান্য গোয়েন্দা টিমের সহায়তা নেওয়া হবে বলেও জানা গেছে।
শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট সম্পর্কে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, গোয়েন্দা কার্যক্রম হচ্ছে একটি টেকনিক্যাল বিষয়। দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। দুর্নীতিতে একাধিক পক্ষ জড়িত থাকে। তাদের দুর্নীতি প্রমাণে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান গোয়েন্দা ইউনিটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জনবল। খুবই কম জনবল নিয়ে কাজ চলছে। এমনকি দুই বছর আগের অনুমোদন হওয়া পদগুলোও পূরণ হয়নি। যারা নিয়োজিত আছেন, তাদের দিয়ে আবার স্বাভাবিক অনুসন্ধান, তদন্ত এমনকি দুর্নীতি প্রতিরোধের কাজও করানো হচ্ছে। ফলে গোয়েন্দা ইউনিটের কাঙ্ক্ষিত সফলতা সেই অর্থে মিলছে না।
নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারলে আশা করা যায় প্রকৃত অর্থেই শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট গঠিত হবে। এতে দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁক-ফোকর থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না— বলেন ওই কর্মকর্তা।
বিদ্যমান গোয়েন্দা ইউনিটের সফলতা ও ব্যর্থতা :
২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনক্রমে কমিশনের চেয়ারম্যানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করে আসছে। এ ইউনিটকে আরও গতিশীল করতে ২০২০ সালের ৮ মার্চ ২২টি জেলা কার্যালয়ে দায়িত্বে থাকা ২২ কর্মকর্তাকে দায়িত্বের অতিরিক্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিটটি মোট ১০ জনের জনবল নিয়ে চালু হয়।
গোয়েন্দা ইউনিট চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত জনবল বৃদ্ধি ও কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনা বা প্রশিক্ষিত জনবল সৃষ্টি করা সম্ভব না হওয়ায় এটি কার্যকর ইউনিট হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমান কর্মকর্তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। তারা শুধু নিজস্ব বুদ্ধি ও কৌশল দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে, এ ইউনিটের ৬৬৫টি অভিযোগ গোপন অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। এর মধ্যে ২৫০টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ৪১৫টি অভিযোগের গোপন অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, যেখান থেকে ১৫৪টি অভিযোগ আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এ ইউনিটের তথ্যের সহায়তায় এ পর্যন্ত ১৩ জন প্রতারককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
পিএসএন/এমআই