বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালির জন্য গর্ব আর অহংকারের । কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া কিছু যুদ্ধ আমাদের এই গর্ব আরো অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক যুদ্ধের ঘটনার কথা আমরা জানি, আবার অনেক লড়াইয়ের কাহিনী আড়ালে চলে গেছে। আজ এমনই এক যুদ্ধের কথা জানাব, যেটি হয় তো আমরা মনে রাখিনি, কিন্তু যে যুদ্ধের কৌশল ভারত, পোল্যান্ডসহ ৩৫টি দেশের সেনাবাহিনীর ডিফেন্স কলেজে পড়ানো হয়। সেটা হলো খুলনার শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, এটা কারো কাছে শিরোমণি সম্মুখ সমর নামেও পরিচিত।
অনেকেরই হয়তো অজানা যে , পুরো বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও খুলনা শত্রুমুক্ত হয় তারও একদিন পর। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বরে। বিশ্বের সেরা কিছু ট্যাংক যুদ্ধের মধ্যে শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ একটি। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খানের এমন সিদ্ধান্ত যথেষ্ট সন্দেহজনক ছিল। কেননা যশোরে পাকবাহিনীর সেনানিবাস ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত। কেউ কেউ মনে করেন মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসার খবরে তাদের সাথে যুক্ত হতেই হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত নেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যশোর সেনানিবাসকে হায়াত খান নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে পারছিলেন না। তাদের বিশাল ট্যাংক রেজিমেন্ট ,পদাতিক সেনা , রাজাকার বাহিনীর বিশাল শক্তি নিয়ে খুলনার শিরোমণি এলকায় জড়ো হয়।

শিরোমণিতে পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তিমত্তা নিম্নরুপ:
১) ৩২টি শেরম্যান ট্যাংক
২) ২টি এম ২৪ চাফি ট্যাংক (প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে)
৩) ১৫০ আর্টিলারি (যেটাকে পাকিস্তান ১৫টি বলে প্রচার করে)
৪) ৪০০ কমান্ডো
৫) নিয়মিত পদাতিক বাহিনী (প্রায় ৫ হাজার সৈন্য)
৬) ১৫০ রাজাকার
কমান্ডার হায়াত খান সেখানে ক্যাম্প গড়ে তুলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকেন। হায়াত খান তার সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ব্রিগেডকে নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। রাস্তায় ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এ খবর পেয়ে ফুলতলার চৌদ্দ মাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গনির নেতৃত্বে একটা বড় কনভয় ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা করে।
১০-১২ তারিখ ফুলতলায় পাক বাহিনীর অবস্থান দখলে একের পর এক হামলা চালায় যৌথবাহিনী। ভৈরব নদী পার হওয়ায় চেষ্টা করলেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে চারদিকের সব অবস্থানে সেনা জোরদার করে ঘিরে ফেলা হয় পাকবাহিনীকে।
বাস্তবে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাকবাহিনীর কৌশলের কাছে যৌথবাহিনী সাময়িক পরাজিত হয়েছিল। যৌথবাহিনী পাকবাহিনীর মূল অবস্থান মনে করে বারবার স্ক্রিনিং পজিশনে (প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিতে মূল প্রতিরক্ষা লাইনের সামনে আরেকটি অবস্থান, এতে প্রতিপক্ষ সহজে মূল লাইন খুঁজে পায় না এবং মূল লাইন প্রস্তুত হতে পারে) হামলা করে যাচ্ছিল। প্রচুর সেনা হতাহত হলেও পাকবাহিনী স্ক্রিনিং পজিশন ধরে রাখে।
১৩ তারিখ থেকে শিরোমণি গোলাগুলিতে কেঁপে ওঠে। কিন্তু পাকসেনাদের অবস্থানের তেমন কোনো ক্ষতি করা যাচ্ছিল না। এয়ার সাপোর্ট চেয়ে খবর পাঠানো হয়। দুদিন ধরে চলে ভারতীয় বিমানের বিরামহীন বোমা হামলা। দুদিন পরে হানাদারদের সাড়াশব্দ একেবারেই কমে যায়। মিত্রবাহিনী ধরে নেয়, পাক বাহিনী হয়তো পিছু হটেছে অথবা ব্যাপক বোমাবর্ষণে মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সূত্র এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ভিন্ন কিছু বলছিল।
মিত্রবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে নিশানার মধ্যে পৌঁছুলে পাকবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। ওই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিপুল সেনা হতাহত হয়। কথিত আছে, এদিন মিত্রবাহিনীর বিমান ভুল করে ফুলতলা থেকে অগ্রসরমান মিত্র সেনাদের পাকিস্তানি সৈন্য মনে করে তাদের ওপর বোমা বর্ষণ করে। ফলে মিত্র বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ট্রাক ভরে ভারতীয় সেনাদের মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখে স্থানীয় লোকজন। পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনী তাদের পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন ভাবে ঢেলে সাজায়। মিত্রবাহিনী মেজর দলবীর সিং খুলনা অভিযানের জন্য মেজর মঞ্জুরকে অধিনায়ক করে দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পন করলেও হায়াত খান তা না মেনে তাঁর বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রাধিক সৈন্য।
১৫ তারিখও সারাদিন থেকে থেমে যুদ্ধ চলে। ব্যাপক হতাহতের পর আর মিত্রবাহিনী যুদ্ধের মূল কমান্ড তাদের হাতে রাখেনি। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া মেজর মঞ্জুরের (পরে ব্রিগেডিয়ার) কাছে তা হস্তান্তর করা হয়। মেজর মঞ্জুর তার কোমরের বেল্ট খুলে টেবিলে রাখেন এবং যুদ্ধ জয় না করে ফিরবেন না বলে পণ করেন। কিছু সূত্র অনুযায়ী, তিনি তার স্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এদিন পর্যন্ত যৌথবাহিনী বড় সাফল্য দেখাতে না পারলেও পাকবাহিনী বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধের ফলে নিজেদের অবস্থান ছোট করে শিরোমণির মধ্যে নিয়ে আসে।
ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে এগোতে শুরু করে মুক্তিবাহিনী। প্রথাগত মিলিটারি ফরমেশেনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ফরমেশনে আক্রমণ হয়। তারপরও, যুদ্ধ এতই ভয়াবহ ছিল যে তা হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিরোমণি যুদ্ধেই প্রথম ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, হাতাহাতি ও বেয়নেট চার্জ, সবই দেখা যায়। শিরোমনিতে সংঘটিত ট্যাঙ্ক যুদ্ধটি একটা ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করে। এ যুদ্ধের অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন মেজর মঞ্জুর। তার এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বর্তমানে শিরোমনি সেনানিবাসে এই মহান যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই দেখতে পাবেন এই যুদ্ধের বর্ণনাযুক্ত স্মৃতিফলক। এখানে আরো গড়ে তোলা হয়েছে চিড়িয়াখানা এবং শিশুপার্ক। এই স্থানটি সেনাবাহিনীর অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত