রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পরিচয় হয় আসিফের সঙ্গে। একপর্যায়ে যা প্রেমের সম্পর্কে রূপ নেয়। নুসরাত তখন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রেমের তিন বছরের মাথায় সম্পর্ক রূপ নেয় পরিণয়ে। বিয়ের প্রথম বছর ভালোই চলছিল সব। একপর্যায়ে নুসরাত বুঝতে পারেন আসিফ বহু নারীতে আসক্ত। প্রতিকারে বাড়ির মুরব্বিদের পরামর্শে সন্তান নেন তিনি। ঘর আলো করে আসে মেয়ে শ্রুতি। তাতেও আসিফের বেপরোয়া জীবনের পরিবর্তন না হওয়ায় গত নভেম্বরে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
তিন বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নুসরাত বলেন, একটির পর একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছিলেন আসিফ। সে মেয়েদের সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ধারণ করে রাখতো তার ফোনে। যা আমিই তার (আসিফের) ফোনে দেখি। সোস্যাল মিডিয়ায় (মেসেঞ্জারে) আমাকে অভিযোগ করে কম বয়সী আরও দুটি মেয়ে। এত কিছুর পরও তার নিজের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা-আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু আমার জীবনটা সে জাহান্নামে রূপ দিয়েছে। এক পর্যায়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিই।
বর্তমানে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করছেন নুসরাত। ইতোমধ্যে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে শেষ করেছেন স্নাতক। পড়তে চান স্নাতকোত্তরও। বর্তমান জীবনের বাস্তবতা নিয়ে জানতে চাইলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ভালোই আছি। দিব্বি চলছে সব। মেয়েটা বড় হয়ে উঠছে। বাবাকে খোঁজে। তখন বলি আমিই তোর বাবা।’
তিক্ততায় ভরা বিবাহিত জীবনের গল্প জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নিজেকে তিল তিল করে আবারও গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। নতুন করে আর বিয়ের কথা ভাবছি না। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবাই যেন একটা সিম্পেথি দেখাতে আসেন। যা আমি চাই না।’
বাড়ছে তালাক, এগিয়ে নারীরা
তথ্য বলছে- গেল বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১২ হাজার ২৬৮টি তালাক দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে তালাক হয়েছে এক হাজার ১১৫টি। মোট হিসাবের মধ্যে সাত হাজার ৮৯০টি তালাক দিয়েছেন নারীরা। পুরুষরা তালাক দিয়েছেন চার হাজার ৩৭৮টি। শতকরা হিসাবে ৬৫ শতাংশ তালাক দিয়েছেন নারী আর ৩৫ শতাংশ তালাক দিয়েছেন পুরুষরা।
অন্যভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, রাজধানীতে দিনে ৩৭টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। যার অর্থ ঘণ্টায় তালাক হচ্ছে একটির বেশি। নারীদের তালাক দেওয়ার মূলে কারণ হিসেবে পাওয়া যায় পরকীয়া। এছাড়াও রয়েছে- যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, সন্তান ও তাদের ভরণ-পোষণ না দেওয়া। অন্যদিকে পুরুষরা বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন স্ত্রীদের প্রতি তাদের সন্দেহ, সংসারের প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা, বদমেজাজ, সন্তান না হওয়া।
এর আগে ২০২০ সালে দুই সিটি করপোরেশনে মোট তালাক কার্যকর হয় ১২ হাজার ৫১টি এবং ২০২১ সালে করোনা মহামারির সময় এই সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৬৬১।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্যানুযায়ী, গড়ে বিবাহিত নারী-পুরুষের দশমিক ৪২ শতাংশই তালাকপ্রাপ্ত। সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে রাজশাহীতে, আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে খুলনা ও সিলেট; তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে ঢাকা ও ময়মনসিংহ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ২০২২ সালে স্বামীর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৯২ জন নারী, আর আত্মহত্যা করেছেন ৯৭ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৭৪ জন।
সিটি করপোরেশনের থেকে পাওয়া তথ্য মতে, তালাক নথিভুক্ত করতে করতে মেয়রের দফতরে আবেদন করতে হয়। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষ আপস কিংবা প্রত্যাহার না করলে কার্যকর হয় তালাক। সিটি করপোরেশনের নথিভুক্ত হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- বেশির ভাগ তালাক দিচ্ছেন নারীরা। পারিবারিক বোঝাপড়ার অভাব নিয়েই মূলত তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে। পাশাপাশি নারীরা এখন বেশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাই তালাকের পর কীভাবে চলবেন তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ নারীর স্বাধীনতা। আজ নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েরা কর্মজীবী হয়েছে। কাজেই তাদের মধ্যে সচেতনতার পাশাপাশি স্বাধীনতাও বেড়েছে। সবাই সবার দাবি নিয়ে, অধিকার নিয়ে সচেতন। তাই তারা মনে করে- নিজের আয় নিয়েই চলতে পারবে। যে কারণে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সবখানে মহামারি আকারে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদ।
অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, বিচ্ছেদের আরও একটি অন্যতম কারণ নিজের পছন্দে বিয়ে করা। তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়- ছয় মাস পরেই সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। যার জন্য সংস্কৃতিগত পার্থক্য, দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য, অর্থনৈতিক বিষয়সহ জৈবিক কারণ দায়ী।
বিচ্ছেদ প্রকৃতিগত কারণেই হবে জানিয়ে নেহাল করিম বলেন, এখানে সরকারের করার কিছু নেই। এটা সম্পূর্ণ মানুষের বিবেকের ব্যাপার। ব্যক্তির মধ্যে যদি সচেতনতা কাজ করে, সংস্কৃতি কাজ করে বা মার্জিতবোধ কাজ করে, তাহলেই তালাক কমবে।
নেহাল করিম বলেন, অসভ্যরা বউরে পেটায়। বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। বউয়ের সাথে কাজের লোকের মতো ব্যবহার করে। টাকা ধরে রাখে। বউ চাইলে দশ টকা বিশ টাকা করে দেয়। যার কারণ- মার্জিতবোধের অভাব। এদেশের বেশির ভাগ লোকের মার্জিতবোধের অভাব রয়েছে, হলফ করে বলতে পারি।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত