ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আরপিও-এর ৯১ ধারার ক্ষমতাবলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় ভোটগ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। ওই ধারায় কমিশনকে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
বুধবার (১২ অক্টোবর) বেলা ২টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গাইবান্ধার ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানান। এর আগে অবশ্য সকাল থেকে নানা অনিয়মের অভিযোগের কারণে ১৪৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫১টির ভোট বন্ধ করে দিয়েছিল ইসি।
এদিকে, গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে রেকর্ড করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে সংসদীয় কোনো আসনের নির্বাচনে অনিয়মের কারণে এত কেন্দ্র বন্ধ করতে হয়নি। এছাড়া ভোট চলাকালে সম্পূর্ণ নির্বাচন বন্ধের ঘটনাও এর আগে ঘটেনি বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। যে কারণে এই ঘটনাকে রেকর্ড হিসেবেও বলছেন ইসির কর্মকর্তারা। অবশ্য আগেই নির্বাচন কমিশনাররা পরিস্থিতি খারাপ হলে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছিলেন।
আইন অনুযায়ী এখন নির্বাচন কমিশন চাইলে পুরো নির্বাচনের তফসিল পুনরায় দিতে পারে। আর কোনো প্রার্থী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে পারশিয়াল নির্বাচনও দিতে পারে। এটা তদন্ত সাপেক্ষে করবে নির্বাচন কমিশন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের ৪০টির মতো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছিল। তবে সে সময় পুরো ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়নি। এতে বিএনপি নেতা মো. আলী জয়ী হয়েছিলেন। সেদিন থেকে গাইবান্ধার মতো এত কেন্দ্র কখনো বন্ধ হয়নি। আর দেশে সংসদীয় আসনের পুরো নির্বাচন বন্ধ করার কোনো উদাহরণও নেই।
এদিকে ভোট বন্ধ করে ইতিহাস গড়লেও অনিয়ম-জালিয়াতিতে কারা জড়িত তা এখনো বের করতে পারেনি ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সিসিটিভি ফুটেজে তিনি এবং অন্য নির্বাচন কমিশনাররা নিজ চোখে ভোটকেন্দ্রে আইন লঙ্ঘন হতে দেখেছেন।
Electionতবে এ ‘আইন লঙ্ঘন’ করে অনিয়ম ও জালিয়াতিতে কারা জড়িত, তা নিয়ে এখনও কমিশন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘কাদের কারণে আজকের এ ভোট (গাইবান্ধা-৫ আসনে) বন্ধ করতে হয়েছে, তা নিয়ে এখনো আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’
সিইসি বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ইমপারশিয়ালি ফেয়ারলি ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। ৫১ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের পর আইন-কানুন পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আরপিওর ৯১ অনুচ্ছেদে যে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত। ভোটগ্রহণ বন্ধ।’
কী আছে আরপিও-এর ৯১ ধারায়?
আরপিওর ৯১ ধারায় বলা হয়েছে- ‘নির্বাচন কমিশন (ক) যদি এ মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি-প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করিতে সক্ষম হবেন না, তাহলে এটা যে কোনো ভোট কেন্দ্র বা ক্ষেত্রমত, সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
(খ) এ আদেশ বা বিধিমালার অধীন কোনো কর্মকর্তা কর্তৃক কোনো ব্যালট পেপার নাকচ বা গ্রহণ সংক্রান্ত প্রদত্ত কোনো আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পারবে।
(গ) এ আদেশ ও বিধিমালার বিধান অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের যে কোনো নির্বাচন যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে পরিচালনা নিশ্চিতকরণের জন্য, উহার মতে, প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি জারি করতে, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য আদেশ দিতে পারবে।
এছাড়াও এই ধরার উপ-ধারাগুলোয় বলা হয়েছে- নির্বাচন কমিশন অনিয়মে জড়িতদের প্রার্থিতা বাতিল করতে বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে। কিংবা ফের তফসিল দিয়ে একেবারে শুরু থেকে পুরো নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। আসনটির উপ-নির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ মোট ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে বুধবার ভোটগ্রহণ হচ্ছিল। সেই সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য এক হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরাও লাগানো হয়েছিল। যেগুলো ঢাকায় কন্ট্রোল রুমে বসে দেখভাল করে অনিয়ম পেয়েছে ইসি।
নির্বাচনি এলাকার মধ্যে সাঘাটা উপজেলায় ১০টি ও ফুলছড়ি উপজেলায় সাতটিসহ মোট ১৭টি ইউনিয়ন মিলিয়ে সর্বমোট ভোটার রয়েছেন তিন লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৩ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৭০ হাজার ১৬০।
এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৫ জন প্রার্থী। তারা হলেন— আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর অ্যাডভোকেট গোলাম শহীদ রঞ্জু, বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও মাহবুবুর রহমান। তবে ভোটে অনিয়মের অভিযোগ এনে দুপুরের দিকে রিপন ছাড়া বাকি প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৩ জুলাই সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৫ আসনটি শূন্য হয়। এরপর এই আসনে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি।


