বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম যেন ছুটছে আগুনের মতো। ধীরে ধীরে বাড়ার পর এবার তা রীতিমতো লাফিয়ে উঠেছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের দরপতন এবং বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তার মাঝে স্বর্ণ আবারও হয়ে উঠেছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ।
সোমবার (২১ এপ্রিল) স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ৪১৫ দশমিক ২৪ ডলারে পৌঁছায়, যা দিনের শুরুতে ছিল রেকর্ড ৩ হাজার ৪২৪ ডলার। ফিউচার মার্কেটেও দামে ছিল বড় উল্লম্ফন—প্রতি আউন্সে বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪২৬ ডলারে।
বিশ্বজুড়ে চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই বৃদ্ধির পেছনে মূল চালক। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-গাজা সংকট বাজারে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে বহু বিনিয়োগকারী ঝুঁকছেন স্বর্ণের দিকে, যেটিকে তারা দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের মান এখন তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার নিয়ে অনিশ্চয়তা ডলারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। সাধারণত ডলার দুর্বল হলে স্বর্ণের দাম বাড়ে—এটাই এখন ঘটছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাজারে প্রভাব ফেলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফেড চেয়ারম্যানের সম্পর্ক নিয়ে জল্পনা, এবং তাকে অপসারণের গুঞ্জন বিনিয়োগকারীদের আরও শঙ্কিত করেছে।
শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের নয়, অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কিনছে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ কাউন্সিলের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রেকর্ড হারে স্বর্ণ কিনেছে, এবং ২০২৫ সালেও এই ধারা অব্যাহত আছে।
বিশেষ করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত স্বর্ণের মজুত বাড়াচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীন চায় ডলারনির্ভরতা কমিয়ে একটি বিকল্প বৈশ্বিক মুদ্রাভিত্তি গড়ে তুলতে, আর সেজন্য স্বর্ণকে কেন্দ্র করে নতুন ভিত্তি তৈরির চেষ্টা করছে।
বাজার বিশ্লেষক ইয়াপ জুন রং মনে করেন, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর টেকসই চাহিদা স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দামের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে ৩ হাজার ৫০০ ডলার। তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে দাম কিছুটা বেশি বেড়ে গেছে।’
ইউবিএস বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাউনোভো জানান, ‘ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং শেয়ারবাজারে মন্দার আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের স্বর্ণে টেনে এনেছে।’
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ স্বর্ণের দাম ৩,৭০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, স্বর্ণ এখন শুধু নিরাপদ নয়, বরং লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচিত।
এই বৈশ্বিক ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের বাজারেও। দেশের ইতিহাসে স্বর্ণের দাম ছুঁয়েছে সর্বোচ্চ স্তর। সোমবার (২১ এপ্রিল) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ৪,৭১৩ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা।
২১ ক্যারেটের দাম এখন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা, এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ টাকা।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছে ২৪ বার। এর মধ্যে ১৮ বার দাম বেড়েছে, আর কমেছে মাত্র ৬ বার।
বাজুসের প্রাইসিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির কারণে বিশ্ববাজারে স্বর্ণ নতুন উচ্চতায় উঠেছে।’
তিনি আরও জানান, ‘যতদিন অনিশ্চয়তা চলবে, স্বর্ণের চাহিদা বাড়তেই থাকবে। আর দাম হয়তো ৩ হাজার ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তবে সেটি নির্ভর করছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বর্ণ তাৎক্ষণিক লাভের জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে সবচেয়ে কার্যকর। অর্থনৈতিক দুরবস্থায়, যেখানেই থাকুন, এটি হতে পারে আপনার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার শক্ত ভরসা।