অন্যান্য শিশুদের মতো ফিলিস্তিনি কিশোর নাজি আল বাবার (১৪) স্বপ্ন ছিল একজন আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার, ‘ঠিক রোনালদোর মতো’। তার নামের অর্থ ‘বেঁচে থাকা’। কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরে জন্মগ্রহণ করা ছেলেটির ভাগ্যে আর বেঁচে থাকাটাই হলো না। গত ৩ নভেম্বর বন্ধুদের সঙ্গে হেব্রনের জঙ্গলে ফুটবল খেলার সময়ই ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হন নাজি।
৩ নভেম্বর যা ঘটেছিল
দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই ছিল বলেন নাজির বাবা ৪৭ বছর বয়সী নিদাল আবদেল মতি। তিনি বলেন, ‘সকালে আমি বেথলহেমে কাজে গিয়েছিলাম। নাজি গিয়েছিল স্কুলে। দুপুর ১২টায় কাজ থেকে ফিরে দেখি নাজি তার স্কুলের কাছাকাছি, বাড়ি ফিরছে। সে আমার ট্রাকে উঠে আমার সঙ্গেই বাড়ি ফিরে আসে।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘দুপুরের খাবার পর, সে বাড়ির বাইরে গিয়ে ফুটবল খেলার অনুমতি চায়। যেখানে সে ফুটবল খেলে, সেই জায়গাটা নাজির দাদার মুদি দোকানের কাছে। তার বাড়ির থেকেও কাছেই।’
দুপুর ৩ টার কিছু পর কিছুক্ষণের জন্য নাজি বাড়ি ফিরে এসেছিল। তারপর আবার খেলতে চলে যায়। কে জানতো, এটাই ছিল জীবিত অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে তার শেষ দেখা।
কিছুক্ষণ পরই বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে, নাজির চাচাতো ভাই দৌড়ে বাড়িতে আসে। চিৎকার করতে থাকে, ‘চাচা নিদাল!’
নাজির পরিবার আতঙ্ক নিয়ে শোনে, ‘ইসরায়েলি সেনারা এসে কাছের একটি মাঠে খেলতে থাকা শিশুদের ওপর গুলি চালিয়েছে। নাজি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
প্রথমে পরিবারটি ভেবেছিল, নাজি শুধু আহত হয়েছে। নাজির বাবা নিদাল এবং চাচা সামির দ্রুত সেই স্থানে ছুটে যান। তখনও সেখানে ১০ জনের ইসরায়েলি সেনাদের একটি দল দাঁড়িয়ে ছিল। সেনাদের তারা যখন, নাজির কথা জিজ্ঞেস করেন, তখন তারা এই দুই ভাইকে মারধর করেন। নাজির বাবাকে হাতকড়া পড়িয়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখেন। তাকে সেনারা এতোটাই মারধর করে যে তার হাত ভেঙে যায়। হাতবাধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকেই নিদাল দেখতে পান, ইসরায়েলি সেনারা নাজির দেহ নিয়ে যায়। নিদাল ও সামিরকেও দ্রুত সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। না হলে তাদেরও মেরে ফেলা হবে।
পরিবার পরে জানতে পারে, দুই ঘণ্টা পর একটি ফিলিস্তিনি অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল। নাজির মরদেহ হালহুলের আবু মাজেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ফরেনসিক মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেছে, নাজির শরীরে চারটি গুলি লেগেছিল-একটি পেলভিসে, একটি পায়ে, একটি হার্টে এবং একটি কাঁধে। আরও জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ৩০ মিনিট পর্যন্ত নাজিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
পরের দিন সকালে নাজির পরিবার হাসপাতালে যায় তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ছিল নাজি। তার মা ৪০ বছর বয়সী সামাহার আল-জামারা জানান, ‘সে তার বয়সের আগেই বড় হয়ে গিয়েছিল। যখন সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল,আমি অনুভব করলাম যে আমি আমার একটি অংশ হারিয়েছি যা আর কখনও ফিরে পাব না।’
নাজির এই মর্মান্তিক মৃত্যু গোটা ফুটবল দুনিয়াকেই শোকস্তব্ধ করেছে। নাজির ক্লাবের কোচ নাসের মেরিব জানান, নাজি ডান পা বেশি শক্তিশালী ছিল এবং তার হেড দেয়ার দক্ষতাও ছিল অসাধারণ। নাজি ছিল দুর্দান্ত প্রতিভাধর। ফুটবল নিয়ে ওর স্বপ্ন ছিল বড়। সে রোনালদোর মতো খেলোয়াড় হতে চেয়েছিল। কিন্তু চারটি গুলি সেই স্বপ্নকে হত্যা করল।
নাজির জানাজায় অংশ নেয় হাজারো মানুষ। ভাঙা হাত নিয়েও নাজির বাবা নিজেই কাঁধে নেন ছেলের মরদেহ। ফুটবল পায়ে মাঠ কাঁপানোর স্বপ্ন দেখা সেই ১৪ বছরের কিশোরকে শেষ বিদায় জানাতে চোখের জলে ভাসে পুরো গ্রাম।
ইসরায়েলি সেনাদের এমন নির্মমতার সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। মৌলিক অধিকার এখন দেশটিতে বিলাসিতা, বাস্তবতা হচ্ছে দেশটির মানুষদের জীবনের নিশ্চিয়তা দিতে ব্যর্থ শান্তির বার্তা দিতে থাকা গোটা বিশ্ব।