সদ্য প্রয়াত সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর আসনে (ফরিদপুর-২) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ইতোমধ্যেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। আসনটিতে এরই মধ্যে নৌকার হয়ে নেতৃত্ব দিতে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলেসহ ১৭ জন। তবে সংসদীয় একটি আসনে নৌকার কান্ডারি হওয়ার দৌড়ে এতজনের মনোনয়ন নেওয়ার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না অনেকেই।
দলীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হলেও এই আসনে নৌকার প্রার্থী হতেই মুখোমুখি হচ্ছেন দুই ভাই। তাই পরিবারতন্ত্র থেকে বের হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগে সাজেদা চৌধুরীর ছেলের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ।
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-২ আসন। ১৯৮৬ সালের সংসদীয় এই আসনটি ছিল জাতীয় পার্টির হাতে। এরপর এরশাদের দল ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আসনটিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রেখেছিল। তবে ১৯৯১ সালে ফরিদপুর-২ আসনের কর্তৃত্ব নেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য ১৯৯৬ এর নির্বাচনে আসনটি হারান। ফলে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির রাজত্ব ছিল ফরিদপুর-২ আসনে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ২০০৮ সাল থেকে আমৃত্যু সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের হয়ে এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এরপর ফরিদপুর-২ আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ফরম সংগ্রহ ও জমা নেওয়া শুরু হয়। সবমিলিয়ে গত শনিবার (১ অক্টোবর) বিকেল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়ন বিক্রি ও জমা নেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দফতর জানিয়েছে, এই সময়ে মোট ১৭ জন দলের হয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এই ১৭ জনের মধ্যে দুইজনই সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবর ওরফে বাবলু চৌধুরী ও শাহদাব আকবর চৌধুরী ওরফে লাবু। এরমধ্যে প্রথম দিনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলেসহ আটজন। আর দ্বিতীয় দিনে সাজেদা চৌধুরীর বড় ছেলে আয়মন আকবর ওরফে বাবলু চৌধুরীসহ আরও নয়জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীরা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ, নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আয়মন আকবর বাবলু চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট জামাল হোসেন মিয়া, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কনিষ্ঠ পুত্র শাহদাব আকবর লাবু, জেলা মৎস্যজীবী লীগের আহ্বায়ক কাজী আব্দুস সোবহান, জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি সাইফুজ্জামান জুয়েল, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আতমা হালিম দুলু, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য সাব্বির চৌধুরী, এয়ার কমডোর (অব.) দেলোয়ার হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা কালাচাঁদ চক্রবর্তী, সাংবাদিক লায়েকুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ মিয়া, পীর সাহেব সায়েম আমির ফয়সাল সামী, হাবিবুর রহমান হাবিব, বাহালুল মজনুল চুন্নু ও এবিএম শফিউল আলম।
এদিকে, সংসদীয় এই আসনের স্থানীয় রাজনৈতিকদের ভাষ্য- সাজেদা চৌধুরীর পরিবারে সেভাবে তার কোনো উত্তরসূরি গড়ে উঠেনি। আর তাঁর ছোট ছেলের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভিযোগের অন্ত নেই।
অন্যদিকে, প্রয়াত সাজেদা চৌধুরীর স্বামী রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন পরই অসুস্থতা ঘিরে ধরে তাকে। এরমধ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন সাজেদা চৌধুরী। এমনকি গত প্রায় চার বছরে সংসদেও যাওয়া হয়নি তাঁর। আর নির্বাচনের পর মাত্র একবার যেতে পেরেছিলেন নিজ নির্বাচনি এলাকায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বনানীতে বড় ছেলে আইমান আকবর বাবলু চৌধুরীর সঙ্গে থেকেছেন সাজেদা চৌধুরী। সেখান থেকে ২০১৬ সালে তার ছোট ছেলে শাহাদাব আকবর লাবু চৌধুরী তাকে নিয়ে আসেন। তখন থেকে ছোট ছেলের ধানমণ্ডির বাসায় থাকতেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা। সেখানেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন তিনি।
তবে সেই ২০১৬ সাল থেকেই সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলের মধ্যে মতের মিল নেই। দীর্ঘদিন ধরেই দুই ভাইয়ের মধ্যে চলছে বিরোধ। যা আবারও প্রকাশ্যে এলো মায়ের আসনে দুই ভাইয়ের আলাদা মনোনয়ন ফরম কেনাকে কেন্দ্র করে।
যদিও ফরিদপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাষ্য- সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে তার মায়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অযাচিতভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন ফরিদপুর-২ আসনে। নিজেকে সংসদ সদস্যের ‘রাজনৈতিক প্রতিনিধি’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। তবে সাংবিধানিক বা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এ ধরণের কোনো পদ নেই।
২০০৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা একটি মামলায় ১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহাদাব আকবর লাবু চৌধুরী। পরে দীর্ঘদিন দণ্ড মাথায় নিয়েই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন। তবে ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে তার সাজা মওকুফ হয়।
এদিকে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ- রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে স্থানীয় ওয়ার্ড, ইউনিটের পদ ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে হস্তক্ষেপ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডেও। আবার সংসদ সদস্য না হলেও মায়ের অবর্তমানে সকল দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
শুধু লাবু নন, ফরিদপুর-২ আসনে মায়ের নাম ব্যবহার করে দুই ভাই-ই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে বড় ভাই আইমান আকবর বাবলু চৌধুরী নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে নানা কারণে রাজনৈতিক সেই অবস্থানও খুইয়েছেন তিনি।
এসব বিবেচনায় স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ, নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জামাল হোসেন মিয়া ও আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আতমা হালিম দুলু। তবে ‘নৌকার টিকিট’ পেতে সবকিছুই নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান এই নেতার আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ নভেম্বর। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এই উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সভায় এই তফসিল চূড়ান্ত করা হয়।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় আগামী ১০ অক্টোবর। এছাড়া মনোনয়নপত্র বাছাই ১২ অক্টোবর ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় আগামী ১৯ অক্টোবর। সবশেষ আগামী ৫ নভেম্বর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এই আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। আর এতে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন ফরিদপুরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা।


