বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির খোঁজে বিশ্বভ্রমণ করেছেন তিনি। অনুসন্ধান করেছেন আমেরিকার সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য দেশের সংস্কৃতির মধ্যে মিল এবং অমিল। কেবল ভ্রমণের মাধ্যমেই অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশ আমেরিকার চিন্তাভাবনা কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সেই উদ্দেশেই তার এ বিশ্বভ্রমণের সূত্রপাত। বলছিলাম ‘হোয়্যার টু ইনভেড নেক্সট’ নামের একটি আমেরিকান ডকুমেন্টারি ফিল্মের কথা। যেটি পরিচালনা করেছেন বিশ্বখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা ও লেখক মাইকেল মুর। ফিল্মটিতে পরিপূর্ণ একটি ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমেরিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে ইতালি, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, নিউনেশিয়া, জার্মানি, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও পর্তুগালের বিকল্প ধারার সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার তুলনা করেছেন মাইকেল মুর। নিচে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির খোঁজে তার বিশ্বভ্রমণের সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো:
ইতালি: মাইকেল মুর তার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে ইতালিতে দেখতে পান, দেশটির জনসংখ্যা ৬১ মিলিয়ন হলেও তারা সেক্সকে অধিক প্রাধান্য দেন। তাদের সংস্কৃতির একটি অন্যতম দিক হলো শ্রমিকদেরর অধিকার নিশ্চিত করা। যা তাদের ভালো জীবন যাপনে সহায়তা করে। ইতালিতে ছুটি বা হানিমুনে যেতে আলাদাভাবে বেতন প্রদান করা হয়। এমনকি পিতা মাতার জন্য সমস্ত ব্যয়ভারও বহন করা হয়। মাইকেল মুর দুইজন শ্রমিক জানি এবং ত্রিস্ট্রিনার সাক্ষাতকার নেন। জানতে চান, তারা কীভাবে ছুটি কাটাতে পছন্দ করেন? তারা জানান, ইতালিরা প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ দিন ছুটি কাটায়। এছাড়াও সরকারি ছুটি রয়েছে ১২ দিন। সাধারণত শীতকালে জুনের প্রথম দিকে ১ সপ্তাহের জন্য প্ল্যান করেন ঘুরতে যাওয়ার জন্য। এমনকি ইতালিরা হানিমুনের জন্য ১৫ দিন পেইড হলিডে পান। এছাড়া ডিসেম্বরে অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয় শ্রমিকদেরকে। তারা মোট ১৩ মাস বেতন পান। ইতালিতে ৫ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় এবং সেই ছুটিতে পুরো বেতন পান তারা। দেশটিতে ব্যাংকগুলোতে ৮০ দিন ছুটি দেওয়া হয়। কিছু কিছু কোম্পানিতে দুই ঘণ্টার জন্য বাড়ি যাওয়া যায় দুপুরের খাবারের জন্য। দুকাটি মোটরসাইকেল কোম্পানির মতো কিছু কিছু কোম্পনিতে মুনাফা বেশি হলে বেতনও বেশি দেওয়া হয়। এছাড়া সুযোগ-সুবিধাও বেশি দেওয়া হয়। মাইকেল মুর নিজ দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পান, আমেরিকায় কোন পেইড হলিডে নেই। তবে অল্প কিছু কোম্পানিতে এক বছরে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পেইড হলিডে দিয়ে থাকে।
ফ্রান্স: মাইকেল মুর ফ্রান্সের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি স্কুলের বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং যৌন শিক্ষার দিকগুলি নিয়ে কথা বলেন। ফ্রান্সিসরা মূলত গণতন্ত্র ও অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা খাবার, সেক্স এডুকেশন ও ট্র্যাক্সকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ফ্রান্সের একটা স্কুল ক্যাফেটেরিয়ার রান্নাঘরও থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলের মতো। ফ্রান্সের স্কুলে খাবারের মেনুতে চিজ, ফলমূল, শাকসবজি দেওয়া হয়। তারা কোকোকোলা জাতীয় কোন পানীয় দ্রব্য পছন্দ করেন না। অন্য দিকে আমেরিকার বাচ্চারা বার্গার, পিজ্জা, মাংস এগুলো বেশি খায়। যেখানে ফ্রান্সের স্কুলের বাচ্চারা বলছে এগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার নয়। ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে সকালের নাস্তার জন্য ২০ মিনিট, দুপুরের খাবারের জন্য ১ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ম্যানার শেখানো হয়। কীভাবে খাবার খেতে হয়, অন্যকে পরিবেশন করা হয় সেসব শিক্ষা দেওয়া হয়।
মাইকেল মুর তুলনা করে দেখেন, আমেরিকার স্কুলগুলো স্বাস্থ্যকর এলাকায় অবস্থিত নয় অন্যদিকে ফ্রান্সের স্কুলগুলো স্বাস্থ্যকর এলাকায় অবস্থিত। ফ্রান্সের সবগুলো স্কুল প্রায় একই রকম। সবথেকে গরীব স্কুলের খাবারের মেনুতে ডিল সস, গোস্ত, মুসাকা, ভ্যানিলা ফ্রাউয়ারস্, চিজ এগুলো প্রতিদিন থাকে। তাদের হেলথ কেয়ার ও ডে কেয়ার রয়েছে।
ফ্রান্সের জনগণ কোথায় কি পরিমাণ ট্র্যাক্স দেয় তা প্রতিটা লাইন বাই লাইন দেওয়া থাকে। ফ্রান্সিসরা যোদ্ধা নন কিন্তু তারা প্রেমিক। তারা ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়। তারা সেক্স এডুকেশনকে প্রাধান্য দেয়। যেখানে আমেরিকায় ‘টিন প্রেগনেন্সি’র হার ফ্রান্সের দ্বিগুণ, জার্মানির থেকে ৬ গুণ এবং সুইজারল্যান্ডের থেকে ৭ গুণ।
ফিনল্যান্ড: মাইকেল মুর তার ভ্রমণে দেখতে পান, শিক্ষার জন্য অন্যতম ভালো রাষ্ট্র হলো ফিনল্যান্ড। দেশটি শিক্ষার দিক থেকে ১ নম্বর অবস্থানে রয়েছে। অন্য দিকে আমেরিকা রয়েছে ২৯ নম্বর অবস্থানে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য কোন পরীক্ষা নেওয়া হয়না। তাদের কোনো হোমওয়ার্ক নেই। তাদের অনেক বেশি সময় দেওয়া হয় মজা করার জন্য। ফিনল্যান্ডে স্কুলে গড়ে সপ্তাহে ২টা ক্লাস করতে হয়। তাদের প্রত্যেকেই একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে। জার্মানি, স্প্যানিস, সুইডিশ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় তারা কথা বলতে পারে। ফিনল্যান্ডের স্কুল হচ্ছে সেটা- যা সুখকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে, যা সুখী করে। ফিনল্যান্ডের সবগুলো স্কুল একইরকম। সেখানে টিউশন ফি নেওয়া অবৈধ। সে কারণে সেখানে কোন প্রাইভেট স্কুল নেই। এটা দ্বারা প্রমাণ করে যে, তারা সবাই ধনী।
অন্য দিকে আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে ব্যবসাকেন্দ্রীক। তারা টাকা উপার্জন করতে শেখায়। আমেরিকার স্কুলগুলোতে রাষ্ট্র সম্পর্কে পড়ানো হয়। সেখানে কোন কবিতা পড়ানো হয়না। কারণ তারা মনে করে, এটা সময়ের অপচয়।
স্লোভেনিয়া: স্লোভেনিয়া ১২টি দেশ ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফ্রি যাওয়া-আসা করতে পারে। স্লোভেনিয়ায় কোন টিউশন ফি নেই। স্লোভেনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার থেকে ১০০০ গুণ ভালো এবং তা তুলনাযোগ্য নয়। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা খুব কঠিন ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো। স্লোভেনিয়ায় অক্ষর ২৫টি কিন্তু আমেরিকায় ২৬ টি। এরা ‘ডব্লিউ’ উচ্চারণ করে না। লুবিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০টার মতো কোর্স রয়েছে যা ইংরোজিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। স্লোভেনিয়ায় কলেজগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। একবার স্লোভেনিয়া সরকার টিউশন ফি আরোপ করার চেষ্টা করলে তা বিক্ষোভের মাধ্যমে তারা দমন করে। ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ডের থেকে আমেরিকার টিউশন ফি অনেক বেশি।
জার্মানি: মাইকেল মুর তার ভ্রমণে বেরিয়ে জানতে পারেন, জার্মানিতে সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয় আর তারা বেতন পান ৪০ ঘণ্টার। তারা যতক্ষণ কাজ করেন ততক্ষণ শুধু কাজই করেন। অবসর সময়টুকু তারা পোষা কুকুর অথবা গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সময় কাটান। জার্মানিতে সার্বজনীন চিকিৎসা সেবা রয়েছে, এমনকি তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ফ্রি সেবা নিতে পারেন তারা। জার্মানিরা ম্যাসাজ করাতে খুব পছন্দ করেন। যখন তারা ম্যাসাজ করায় তখন তারা মনে করে যে, তারা স্বর্গে বাস করছে। প্রতিদিন জার্মানির প্রতিটি স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হয় যা তাদের পূর্বপুরুষেরা করে গেছে। তারা কীভাবে জীবনযাপন করেছে সেসব গল্প করতো, যা জার্মানির নাৎসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাস্তায়, সাইনবোর্ডে লিখে রাখে। যাতে তারা পূর্বপুরুষদের ভুলে না যায়। কখনও কেউ কোন যুদ্ধ বা কোথাও থেকে চলে যাবে আর কখনো ফিরে আসবে না এমন পরিস্থিতিতে তাকে ফিরিয়ে আনতে কি কি স্মৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যায় সেজন্য সেসব বস্তু দিয়ে একটা স্যুটকেস ভর্তি করে রাখেন তারা।
পর্তুগাল: মাইকেল মুর জানান, পর্তুগাল ক্রীতদাস প্রথার অংশ হিসেবে ড্রামকে ব্যবহার করে। তারা ‘মে ডে’ পালন করে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রই ‘মে ডে’ তে কাজ বন্ধ রাখে কিন্তু আমেরিকানরা তা করেন না। পর্তুগালে মাদক ব্যবহার করার জন্য কাউকে আটক করা হয়না। গত ১৫ বছরে কাউকে সেখানে আটক করা হয়নি। এমনকি তাদের কোন শাস্তির ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু আমেরিকায় মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এমনকি তাদের ভোট দেওয়ারও অধিকার নেই। মানুষের মর্যাদাই হচ্ছে পর্তুগালের সমাজের মেরুদণ্ড এমনকি পর্তুগালে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নেই। কারণ তারা মনে করে মৃত্যুদণ্ড মর্যাদাহানিকর। এছাড়াও পর্তুগালে রয়েছে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, যাতে মাদকসেবীরাও স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারে।
নরওয়ে: নরওয়ের কারাগারের সিস্টেম হলো পুনর্বাসন ও কোন প্রতিশোধ স্পৃহা না জাগানো। কারাগারে টিভি দেখা, সাইক্লিং, বাস্কেটবল খেলা, মাছ ধরা সবই করা যাবে, শুধু বাইরে যেতে পারবে না। তাদের মূল থিম হচ্ছে- আসামিদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নেয়া। তারা তাদের বন্ধু, পরিবারকে মিস করবে, এটাই তাদের শাস্তি। কারাগারে আসামিরা অস্ত্রও রাখতে পারে। একটা ভবনে ১১৫জন আসামির বিপরীতে মাত্র ৪ জন নিরস্ত্র গার্ড থাকে। অন্য দিকে আমেরিকা অপরাধ প্রবণতার দিক থেকে বিশ্বে অন্যতম। আর ৮০ ভাগ আসামিই পাঁচ বছরের মধ্যেই আবার গ্রেপ্তার হয়। এদিকে নরওয়েতে সবথেকে নিম্ন ২০ ভাগ। নরওয়ের আসামিরা ভোট দিতে পারেন। এমনকি তারা কারাগারের ভেতর থেকে ডিবেট করতে পারেন, লাইভ প্রোগামে যোগ দিতে পারেন। কারাগারে যে লাইব্রেরি আছে তা আমেরিকার স্কুল লাইব্রেরির মতোই। সেখানে রেকর্ডিং স্টুডিও রয়েছে। তাদের সবার মূল থিম হলো নরওয়ের যত্ন নেওয়া। নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ২১ বছরের জেল। যা বিশ্বের সর্বনিম্ন খুনিদের শাস্তি।
তিউনিশিয়া: উত্তর আফ্রিকার একটা মুসলিম দেশ তিউনিশিয়া। নারীদের জন্য ফ্রি হেলথ কেয়ার রয়েছে এবং সেখানে ১৯৭৩ সাল থেকে গর্ভপাত বৈধ ও গর্ভপাত ফ্রি। সেখানে নারীদের সমান অধিকার রয়েছে। নারীরা ভালো শিক্ষা, ভালো কাজের সুযোগ পায় যাতে সে অধিকতর ভালো জীবনযাপন করতে পারে এবং পরিবার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশটিতে সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তিউনিশিয়ান বিপ্লব তথা আরব বসন্তে সে দেশের মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম রাষ্ট্র হলেও মেয়েদের হিজাব পড়া বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া মেয়েদের পোশাক ও জীবন-যাপনে রাষ্ট্র কোন হস্তক্ষেপ করে না।
আইসল্যান্ড: আইসল্যান্ডে ১৯৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর নারী আন্দোলন বা ধর্মঘট শুরু হয়। এরপর থেকে বছরের ওইদিনে ৯০ ভাগ নারী কোন কাজ করে না। কোন স্কুল, ব্যাংক খোলা থাকে না, বাস চলাচল করে না। নারীরা ওইদিনে কোন কাজ করে না। তারা তাদের গুরুত্ব বোঝায় এবং ছেলে মেয়ে উভয়ই সমান তা বুঝায়। আন্দোলনের পাঁচ বছর পরে এই দিনে তারা বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। আইসল্যান্ডে বড় কোন কোম্পানিতে ৪০% মেয়ে ও ৪০% পুরুষ কোটা থাকে।
মাইকেল মুরের এই বিশ্বভ্রমণের প্রাপ্ত জ্ঞান বা বিভিন্ন দেশের উন্নত চিন্তাধারা বা তাদের ভালো দিক নিয়ে যদি কোন দেশের অবকাঠামো ঢেলে সাজানো হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে পুরো বিশ্বের জন্য আদর্শের বিষয় হবে। মূলত আমেরিকাকে এভাবে ঢেলে সাজানোর বাসনা থেকেই এ বিশ্বভ্রমণ করেন এবং যা ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে তুলে ধরেন।