সাকিবুর রহমান
আজ (২৫ এপ্রিল) খুলনা জেলার ১৪৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ভৈরব-রূপসা বিধৌত খুলনার ইতিহাস-ঐতিহ্য অত্যন্ত গৌরব মন্ডিত। খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা এবং ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় খুলনাকে শিল্প নগরী হিসেবে ডাকা হয়। খুলনা শহর থেকে ৪৮ কি.মি. দূরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলা সমুদ্র বন্দর অবস্থিত। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত। খুলনাকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বলা হয়।
ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। রাজধানী সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে স্থলপথ, আকাশপথ, জলপথ ব্যবহার করা যায়। ১৯১২ সালে থেকে খুলনা অঞ্চলে নদীপথে স্টিমার চলাচল শুরু করে।
খুলনা নামকরণের ইতিহাস খুলনা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, খুলনা নামকরণের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘খুলনেশ্বরী মন্দির’ নামকরণের মধ্যদিয়ে খুলনা নামের উৎপত্তি। ‘খুলনেশ্বরী মন্দির’ ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুলনার নামে নির্মিত। এছাড়া ১৭৬৬ সালে ‘ফলমাউথ’ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার করা রেকর্ডে লিখিত Culnea শব্দ থেকে খুলনা নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে ‘কিসমত খুলনা’ মৌজা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে লিখিত Jessore-Culna শব্দ থেকে খুলনা এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
খুলনা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
খুলনা পৌর এলাকা অতীতে জসর (যশোহর) জেলার মুরলী থানার অন্তর্গত ছিল।
পরে রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে তালিমপুর, শ্রীরামপুর (রহিমনগর) এর কাছে সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে নতুন থানা স্থাপন করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় নওবাদ (নয়াবাদ)। কারো কারো মতে এ নতুন থানা ১৭৮১ খ্রিঃ আবার কারো মতে ১৮৩৬ খ্রিঃ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ১৮৪২ সালে ভৈরব-রূপসা বিধৌত পুণ্যভূমি নয়াবাদ থানা ও কিসমত খুলনাকে কেন্দ্র করে নতুন জেলার সদর দপ্তর স্থাপিত হয় খুলনায়। পরে তার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানের খুলনা ও বাগেরহাট জেলা দুটি নিয়ে ছিল খুলনা মহকুমা। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাটে স্বতন্ত্র মহকুমার কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৮৪৫ সালে সেখানে প্রথম দালান কোঠা ওঠে যা আজকে জেলা প্রশাসকের বাসভবন।
খুলনা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রিটিশদের প্রশাসনিক এলাকা বৃদ্ধি এবং ভৌগলিক অবস্থার কারণে খুলনা অল্পসময়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অবিভক্ত বাংলায়। ৪০ বছরের ব্যবধানে ৪ হাজার ৬৩০ বর্গমাইল এলাকা, ৪৩ হাজার ৫০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাকে নিয়ে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। খুলনার প্রথম প্রশাসক ছিলেন ডেপুটি মিঃ শোর এবং দ্বিতীয় মহকুমা হাকিম ছিলেন সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।এই বাসভবনেই রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দিনী’। পরে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিলের সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী খুলনা জেলার জন্ম হয় এবং তৎকালীন যশোহর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা দুটি এবং ২৪ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়ে ১ জুন থেকে এ জেলার কাজ শুরু হয়। প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ ডব্লিউ এন ক্লে। এখনকার ক্লে রোড তার নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী আজ খুলনার ১৪৩তম জন্মবার্ষিকী আজ।
মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে ভৈরব নদীর অপর পাড়ে সেনহাটিতে খুলনার প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল খুলনার প্রথম মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপন করা হয় সাতক্ষীরাতে। দ্বিতীয় মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৭৬ সালে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটায়।
তবে ১৯৫৫ সালে সেটি বাতিল হয়ে ইউনিয়ন বোর্ডে পরিণত হয়। জেলার তৃতীয় মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৮৪ সালে খুলনা শহরে। এর দুই বছর পর ১৮৮৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিউনিসিপ্যালিটির দ্বিতীয় সভায় ভাইস চেয়ারম্যান বাবু কৈলাশচন্দ্র কাঞ্জিলালের বাড়ি সত্যচরণ হাউসে সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস স্থাপন করা হয়। এখান থেকেই মূলত পরিচালিত হতো শহরের প্রশাসনিক কর্মকান্ড। আজ আর সে ভবনের অস্তিত্ব না থাকলেও অনেকের মতে ভবনটি বর্তমান পৌর ভবনের সন্নিকটে ছিল।
১৮৫৬ সালে কালেক্টর ভবনের পাশে খুলনার প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। এই মসজিদটি নগরীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদগাহ জামাত স্থল। বর্তমানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান স্থান খুলনা। নদী বন্দর, উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং সমতল ভুমির কারণে এ শহরটি প্রসারিত হয়েছে দ্রুতগতিতে। জনবসতি বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুলনার ভুমিকা অগ্রগামী।