
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রথম সেশনে ছয়টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসে। সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নির্বাচন আচরণ বিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করেন। অপরদিকে, অংশগ্রহণকারী দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা সংকট, কালো টাকার প্রভাব এবং জামানতের টাকা কমানোর দাবি জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন।
সহযোগিতা ছাড়া খেলা মুশকিল: সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, নির্বাচনে খেলবেন আপনারা। আমরা রেফারির ভূমিকায় নিরপেক্ষ থাকতে চাই। সহযোগিতা ছাড়া খেলাটা পরিচালনা করা মুশকিল।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা নিয়ে একটি ‘সুষ্ঠু, সুন্দর, ক্রেডিবল নির্বাচন’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন এবং সহযোগিতা না পেলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সিইসি দলগুলোকে আচরণ বিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ যদি ‘গো ধরে বসে থাকে যে মানবোই না, তাহলে তো একটা সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বিধি ভাঙলে আমরা অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বো।
ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সিইসি বলেন, যারা লাগিয়েছেন তারা যেন নিজে থেকে সরিয়ে ফেলেন। এটাই হবে ভদ্র আচরণ।
তিনি হুঁশিয়ারি দেন, যে দল এটি করবে না, তাদের নিয়ত সাফ না বলে মনে করা হবে এবং ইসি তা সহ্য করবে না। নিবন্ধিত ৫৪টি দলই আমাদের কাছে সমান।
গণভোট প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ইসি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানে না, তবে এটি নিয়ে আলোচনা আছে। এটি যদি ইসির ওপর এসে পড়ে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হবে।
প্রবাসীদের ভোট ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা করার ঘোষণা দেন। প্রবাসীরা ১৮ নভেম্বর থেকে অ্যাপে (পোস্টাল ভোট বিডি) নিবন্ধন করতে পারবেন।
দেশে অবস্থানরতদের বিষয়ে তিনি জানান, দেশের ভেতর থেকে যারা এখন আবেদন করছেন তারা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারবেন না, কারণ এর সময় অক্টোবরে শেষ হয়েছে।
তিনি জানান, ভবিষ্যতে হয়তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবো না। এতে পাবলিকের টাকা নষ্ট হচ্ছে।
প্রবাসীদের ভোট ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ট্রায়াল ছাড়াই প্রধান উপদেষ্টার অঙ্গীকার রক্ষার্থে এক্সারসাইজটা হাতে নিয়েছি। এটিতে ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে বলেও তিনি স্বীকার করেন এবং হোঁচট এড়াতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
নারীর অংশগ্রহণ ও আস্থাহীনতার চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদ আহমেদ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে নারী-পুরুষের ফিফটি ফিফটি অংশগ্রহণ বলে মনে করেন।
নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের সমাজ পুরুষ প্রধান সমাজ, তাই পুরুষরা সহযোগিতা না করলে মহিলারা অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তিনি পুরুষদের প্রতি অনুরোধ জানান যেন মহিলারা যাতে ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারে তারা (পুরুষ) সে দায়িত্ব নেন।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার আস্থাহীনতাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন। আস্থা পুনরুদ্ধারে তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার জো নেই। এই আস্থাটাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং যাবো।
গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে তিনি রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা ছাড়া ভালো নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে বলেন, এবার কিন্তু আমাদের জন্য একটা সুযোগ, এবারের নির্বাচন যদি আমরা ভালো না করতে পারি, আমরা কিন্তু নদীর মাঝখানে নৌকাটা এমন নড়াচড়া করলে ডুবে যাবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও উদ্বেগ
সংলাপে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, এলডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ কংগ্রেস ও এনপিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
নিরাপত্তা উদ্বেগ (এলডিপি) জানিয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ডক্টর চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বলেন, এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট নিরাপত্তা সংকট বিরাজ করছে এবং কিছু দল চিহ্নিত সন্ত্রাসী ব্যবহার করছে। তিনি তফসিল ঘোষণার পূর্বেই একটি নিরাপত্তা সিকিউরিটি অপারেশন করার দাবি জানান।
কালো টাকার প্রভাব
অতীতের নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব বিস্তার এবং হুমকি-ধামকির মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার বিষয়টি তুলে ধরেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী। তিনি ইসিকে আগে থেকেই এগুলো প্রতিহত করার জন্য প্রোগ্রাম করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক দলের ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্য রাখার শর্তটি বিশেষ করে ইসলামী দলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে যায় এবং এটি বিবেচনার দাবি জানান।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ সালাউদ্দিন সালু জামানতের টাকা ৫০ হাজার করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটা বুর্জোয়া দলের পক্ষে সম্ভব হলেও তাদের মতো দলের পক্ষে কঠিন। তিনি জামানত ২০ হাজার টাকা রাখার দাবি করেন।
নির্বাচনী পরিবেশের বিষয়ে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের উপদেষ্টা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবু সঠিক সময়ে নির্বাচন চান এবং পরিবেশ উন্নয়নের জন্য ইসির চেষ্টা কামনা করেন।
বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, বড় দলগুলো নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং মহড়া চলছে। ইসি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, এই কমিশনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে নতুন ইতিহাস তৈরির প্রত্যাশা জানান এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মতো আরেকটি নির্বাচন চাপিয়ে দিলে তা কমিশনের জন্য কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত