বাংলা সনের চৈত্র মাস। মাসটি আসলেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা তৎপরতা বাড়ত। পুরাতন হিসাব বন্ধ করা, নতুন হিসাব চালু করা, অনাদায়ী টাকা সংগ্রহ করা, লাল রঙের নতুন খাতায় হিসাব শুরু করা, রঙিন কার্ড দিয়ে দাওয়াত দেওয়াসহ নানা আয়োজন। কিন্তু এখন এসব প্রায়ই ফিকে হয়ে গেছে। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ভিড়ে ধীরে ধীরে সব হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর নেই সেই আদিকালের হালখাতা। খাতা বদল কিংবা মিষ্টি খাওয়ার প্রথা অব্যাহত থাকলেও আগের জৌলুসপূর্ণ সেই হালখাতা আর নেই। আগামী বৃহস্পতিবার ১ বৈশাখ। বুধবার হালখাতার দিন।
জানা যায়, অতীতে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হালখাতা করা হতো। বাহারি ফুল, ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হতো দোকান। দোকানে দোকানে সাজানো থাকত ‘শুভ নববর্ষ’, ‘শুভ হালখাতা’ লেখা। খোলা হতো নতুন খাতা। পুরাতন বছরের বকেয়া পরিশোধের পর হতো মিষ্টিমুখ। পরস্পর কোলাকুলি। তৈরি হত বাঙালির মিলনমেলা। এখন আর সেই উৎসব নেই। এসব দখলে নিয়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল এবং নগদ লেনদেনের চেক, ব্যাংকিং লেনদেন কিংবা নগদ টাকা। ফলে চৈত্রালি করার জন্য এখন আর বাংলা সনের শেষ দিনের জন্য অনেকেই আর অপেক্ষা করে না। উদযাপন হয় না হালখাতা উৎসব। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষের সেই হালখাতা উৎসব। হালখাতা না থাকলেও খাতা তৈরির কর্মযজ্ঞ আছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের মালিক সোলাইমান বাদশা বলেন, এখন আগের সেই জৌলুসপূর্ণ হালখাতা নেই। হালখাতার জন্যও কেউ এখন আর অপেক্ষা করেন না। তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় কেবল মিষ্টি খাইয়ে হালখাতা উৎসব পালন করা হয়। তিনি বলেন, এখন ব্যবসায়ীরা সপ্তাহ, ১৫ দিন কিংবা এক মাসের চেক দিয়ে ব্যাংকিং লেনদেন করেন। অথবা সরাসরি নগদ ব্যবসা করেন। তাই হালখাতার জৌলুসটা ফিকে হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের হাজারী গলি, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ও টেরিবাজারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীক কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই চিরচেনা সেই হালখাতার চর্চা চলছে না। কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের মাধ্যমে রাখা হচ্ছে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের হিসাব। এখন আর দেখা মিলছে না ক্যাশিয়ারের পাশে চিরচেনা লাল কাপড় বা কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটি। অনেকের কাছে কোনো আগ্রহও নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে হালখাতা বিষয়টি এখন অজানা।
জানা যায়, হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। এরপর মোগল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। এর সঙ্গে শুরু হয় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। মোগল আমল থেকেই পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন। পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টি মুখ করানোর পাশাপাশি আনন্দ উৎসব করতেন। এছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার পয়লা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। কিন্তু ডিজিটালের ভিড়ে বাঙালির ঐতিহ্য হালখাতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের হালখাতা উৎসব আজ আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কাছে টিকতে পারছে না।
পি এস/এন আই
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত