অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে খুলনায় চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের পতন কাটিয়ে এই সেক্টর আবারও আশার আলো দেখাচ্ছে, যাকে একসময় দেশের "সাদা সোনা" বলা হতো।
এক সময় কাঁচা পাটের পরেই রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল চিংড়ি। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাননামি চিংড়ির আধিপত্যের কারণে গত এক দশকে খাতটি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়।
কিন্তু মৎস্য অধিদপ্তরের নতুন পদক্ষেপ এবং বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আবারও এই শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে খুলনা চিংড়ি রপ্তানি থেকে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আয় করেছে। আগামী পাঁচ বছরে এই আয় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত খুলনার রপ্তানিকারকরা ৩,৪৮৩.২৪ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৮০.৪৫ কোটি টাকা বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে খুলনায় ১,২৩,১৫১ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১৯,৫১২ টন রপ্তানি করে ২,৪৯৯ কোটি টাকা আয় হয়। এর মধ্যে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ১৩,০১৯.৮০ টন, যার মূল্য ১,৯৯০.৩৯ কোটি টাকা। যা দেশের মোট মাছ রপ্তানির ৪২.১৯ শতাংশ।
গত পাঁচ বছরে এ অঞ্চলে ১,৫৩,৩৮৮ টন সাদা মাছ রপ্তানি করে ১৩,৪৫৬ কোটি টাকা এবং ১,০২,৩৪০ টন চিংড়ি রপ্তানি করে ১১,৩০১ কোটি টাকা আয় হয়েছে।
টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে মৎস্য অধিদপ্তর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক চিংড়ি চাষ পদ্ধতিতে ১০,৭৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া, ৭,৫০০ জন কৃষককে উৎপাদন উপকরণ সহায়তা, ক্লাস্টারভিত্তিক চাষ প্রচলন (যা উৎপাদন ২-৫ গুণ বাড়াতে পারে), মাঠ পর্যায়ে প্রদর্শনী আয়োজন, বায়োসেফটি ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ এবং তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন উৎসাহিত করা যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দাম পাওয়া যায়।
“রপ্তানি বাড়াতে হলে উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই,” বলেন খুলনার বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার।
তিনি দীর্ঘমেয়াদি চিংড়ি-কেন্দ্রিক প্রকল্প গ্রহণ, চাষের অঞ্চলভিত্তিক জোনিং, রোগমুক্ত রেণু ও খাদ্যের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ এবং খামার পর্যায়ের কঠোর নজরদারির ওপর গুরুত্ব দেন।
ইপিবি খুলনার পরিচালক জীনাত আরা সাম্প্রতিক উন্নতির পেছনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উন্নত ভাবমূর্তিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা কিছুটা সতর্ক। “খুলনায় একসময় ৬৩টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছিল, কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়া ও বৈশ্বিক চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়ায় এর মধ্যে ৩৩টি বন্ধ হয়ে গেছে,” বলেন ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিকুল ইসলাম জাহির।
তিনি শিল্পকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিদ্যুৎ ও উৎপাদন ব্যয়ে সরকারি ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান।
রপ্তানিকারকরা জানান, ইউরোপের বাজারে চাহিদা ও দাম এখনও চাপে রয়েছে। পাশাপাশি বিলম্বিত অর্থপ্রদান, উচ্চ উৎপাদন খরচ ও রোগবালাইও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তবুও সাম্প্রতিক সময়ে উৎপাদন ও রপ্তানির ঊর্ধ্বগতিতে কৃষক, প্রক্রিয়াজাতকারী ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। খুলনার চিংড়ি শিল্পের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত