আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত এক ইবাদত ‘সদকাতুল ফিতর’। হাদিস শরিফে সদকাতুল ফিতরকে কাফফারাতুন লিসসাওম—অর্থাৎ ‘রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, তার ক্ষতিপূরণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের মতো রমজান মাসের যেকোনো সময়েও আদায় করা যায়।
ইসলামি শরিয়তে ‘ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন ও নারী-পুরুষ সবার ওপরই এটি ওয়াজিব’ (সহিহ বুখারি: ১৫১২)। এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফতোয়া আলমগিরি: ১/১৯২)
যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির: ২/২৮১)
সদকাতুল ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় কারো কাছে বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব।
পাঁচ ধরণের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। খেজুর, পনির, জব, কিসমিস এবং গম। সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘অর্ধ সা’। ১) খেজুর, পনির, জব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ‘সা’=৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)—অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। ২) গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম, অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃ. ১৮)
দুটির যে কোনো একটিকে পরিমাপ ধরে আদায় করলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য যিনি সামর্থ্য অনুযায়ী যত বেশি আদায় করবেন তিনি তত বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবেন।
গম ছাড়া বাকি চারটি বস্তু দ্বারা আদায় করলে তিন কেজি তিনশো গ্রাম এবং গম দ্বারা আদায় করলে দেড় কেজির চেয়ে একটু বেশি আদায় করতে হয়। এবার যদি কেউ খেজুর দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতে চায়, তাহলে আজওয়া (উন্নতমানের) খেজুরের মূল্য প্রতি কেজি ১০০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৩২৫৬/- তিন হাজার দুই শত ছাপ্পান্ন টাকা। মধ্যম ধরনের খেজুর যার মূল্য প্রতি কেজি ৩০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৯৭৭/- নয়শত সাতাত্তর টাকা।
কিসমিস প্রতি কেজি ২৩০/- টাকা করে হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৭৪৮/- (সাত শত আটচল্লিশ) টাকা।
পনির প্রতি কেজি ৫০০/- টাকা করে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ১৬২৮/- (এক হাজার ছয় শত আটাশ) টাকা।
গম প্রতি কেজি ৪৫ টাকা হিসাবে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৭০ টাকার মতো।
এখন উচিত হলো, আমরা প্রত্যেকে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করব। যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ দামেরটা দেবো। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, যাদের খেজুরের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ আছে, তারাও সর্বনিম্ন গমের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করে। এমনভাবে যাদের কিসমিসের মূল্য দিয়ে আদায় করার সামর্থ আছে, তারাও গমের মূল্য দিয়ে আদায় করে। এটি সঠিক পদ্ধতি নয়। নবী কারিম (স.)-কে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন-
أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها
‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’। (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮; সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান: ১/৬৯)
সুতরাং, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসেবে সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে, সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসেবে দেওয়ার, সে তাই দেবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসেব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসেবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিই উত্তম নিয়ম। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা। সাহাবায়ে কেরাম আধা সা গম দিয়ে সদকা আদায় করার কারণ ছিল, আধা সা গমের মূল্য তখন এক সা খেজুরের সমান ছিল।
হজরত মুআবিয়া (রা.) এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা’ গমকে সদকাতুল ফিতরের অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হত। ( আল ইসতিযকার: ৯/৩৫৫)
তাই মুমিন মুসলমানের উচিত, শুধু গমের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় না করে সামর্থনুযায়ী খেজুর, পনির এবং কিসমিসের মুল্য দিয়েও সদকাতুল ফিতর আদায় করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে সঠিকভাবে সদকাতুল ফিতর আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
পি এস/এন আই
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত