পাহাড়ের বুক জুড়ে ফুটে আছে কাশফুলের মতো একটি ফুল। পাহাড়ি নারী-পুরুষরা ফুলগুলো সংগ্রহ করে আঁটি বেঁধে বিক্রি করছেন বাজারে। কাশফুলের মতো দেখতে এই ফুলগুলোকে স্থানীয়রা ‘উলু ফুল’ বলে ডাকে। সবার কাছে এটি পরিচিত ঝাড়ু ফুল হিসেবে। লাভজনক হওয়ায় বান্দরবানের পাহাড়িরা এখন বিভিন্ন ফল বাগানের সঙ্গে উলু ফুলের চাষ করছেন। আবার অনেকে শুধু উলু ফুলের বাগান করছেন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম উৎস প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এই উলু বা ঝাড়ু ফুল।
অনেক ব্যবসায়ী গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিনেন। এখন মৌসুমে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কাঁচা এই উলু ফুল সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখেন। তারপর ১৮-২০টি কাঠি দিয়ে একটি আঁটি বাঁধেন। এক আঁটি বিক্রি হয় ১৫-১৮ টাকায়।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে প্রাকৃতিকভাবে হতো। গত দুই-এক বছর ধরে তারা সচেতনভাবে চাষ করছে। বিনা পরিচর্যায় চাষ করা যায়। শুধু লাগিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোনো সার, পানি বা কীটনাশক কিছুই লাগছে না।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার রিসাং ঝরনা এলাকার উলু ফুল চাষি আপন ত্রিপুরা বলেন, তিন-চার বছর আগে বন-জঙ্গল থেকে পাহাড়ি ছেলে-মেয়েরা কোঁজ করে সংগ্রহ করে দশ আঁটি করে বেঁধে ১ থেকে ২ টাকায় বিক্রি করত। আর এখন একটি আঁটি ১ বিক্রি হয়। দাম বাড়ছে। উলু ফুলে সুন্দর জীবন চলে। যাদের পাঁচ-দশ একর পাহাড় আছে, তারা বিভিন্ন ফলের বাগানের সঙ্গে উলু ফুলের চাষ করছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ বলেন, গত বছর তুলনায় এ বছর ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার, ভারত থেকে উলু ফুল আসায় আমাদের উলু ফুলের দাম কমে যাচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেন, খাগড়াছড়ির সব উপজেলা থেকে উলু ফুল সংগ্রহ করি। রোদে শুকাই। বিশটি করে আঁটি বাধা হয়। ২৩ থেকে ২৫ টাকা দাম পাই। সারাদেশে বিক্রি করি। এক ট্রাকে ত্রিশ হাজার আঁটি ধরে। এক ট্রাকে ৯ লাখ টাকা পাই।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার হৃদয়মেম্বার পাড়া উলু ফুল চাষি রতন ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে উলুফুল প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। শিকড় তুলে অন্য জায়গায় লাগালেও হয়। এ কারণে পাহাড়ে বাগান বাড়ছে। যাদের পাহাড় আছে তারাই উলু ফুলের বাগান করছে প্রচুর। পাহাড়িরা দাম পায় না। পাহাড়িরা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে পারে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়।
খাগড়াছড়ি উলু ফুল সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, খাগড়াছড়ি জেলায় পাঁচশ স্থানীয় ব্যবসায়ী আছি। উলু ফুল কাটা, বাঁধা, রোদে শুকানোসহ এখানে দুই হাজার শ্রমিক মাঠে কাজ করেন।
তিনি বলেন, ইদানিং ভারত, মিয়ানমার, নেপাল থেকে উলু ফুল দেশে আসার কারণে এই ব্যবসাটা হুমকির মুখে। তেমন একটা লাভের মুখ দেখছি না। সরকারকে অনুরোধ করি, আমরা এ ব্যবসায় যাতে টিকে থাকতে পারি। এটা আমাদের দেশীয় সম্পদ। এর সাথে কয়েক হাজার মানুষ জড়িত।
খাগড়াছড়ি থেকে দেশের ৬৪ জেলায় ফুল পাঠাচ্ছি। খোলায় দৈনিক ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ জন শ্রমিক কাজ করে। এক ট্রাকে ৩২ হাজার উলু ফুলে খরচ হয় ৮ লাখ টাকা। খাগড়াছড়ি থেকে এক মৌসুমে ৮০০ ট্রাক উলু ফুল যায় সারাদেশে। তাতে ৪৮ কোটি টাকা উলুফুলের ব্যবসা হয়। জেলায় ৬০ জনের মতো ব্যবসায়ী আছে। সারাদেশে পাঁচশ জন ব্যবসায়ী আছে।
টাঙ্গাইল পটলবাজার থেকে আসা ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, উলু ফুল কিনে ঢাকা নিয়ে যাই এবং পাইকারি বিক্রি করি। খুবই লাভজনক ব্যবসা। এক মৌসুমে আমরা বিশ থেকে বাইশ ট্রাক মাল নিয়ে যাই। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে উলু ফুল সংগ্রহ করি।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, উলু ফুল একটি লাভজনক ফসল। কৃষকরা বিভিন্ন ফল বাগানে আবাদ করছেন। মূল ফসলের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে তাদের বাড়তি আয় হচ্ছে।
তিনি বলেন, চাষিরা ফল বাগান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সেখানে আমরা চেষ্টা করছি এর ফাঁকে ফাঁকে কফি-বাজুবাদাম গাছ লাগানো যায় কিনা কাজ করছি।
খাগড়াছড়ি বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, গত অর্থ বছরে খাগড়াছড়ি বনবিভাগ ৩৩ লাখ ৬০ হাজার উলু ফুলের বিপরীতে ১১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। চলতি অর্থ বছরে ৩৪-৩৫ লাখ উলু ফুল কালেকশন হবে এবং ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব পাব বলে আশা করি।
খাগড়াছড়ি জেলায় সম্প্রতি ব্যক্তি উদ্যোগে বেশকিছু উলু ফুলের বাগান সিজন করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং উলু ফুল থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে ও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা প্রতি বছর প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করি। এ বছর সেখানে উলু ফুল চাষ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত