সুন্দরবন ও সুস্বাদু চিংড়ির জন্য পরিচিত খুলনা অঞ্চল, বর্তমানে আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্য উপাদান চুইঝালের (পাইপার চাবা) মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এক সময় কেবল স্থানীয় মসলা হিসেবে ব্যবহৃত চুইঝাল এখন দেশজুড়ে এবং বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
চুইঝাল গাছ দেখতে পানের লতার মতো এবং এর মূল ও কাণ্ড রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এটি খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর ও নড়াইল অঞ্চলে বহুল ব্যবহৃত মসলা।
ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের বারাতিয়া গ্রামের নবদ্বীপ মল্লিক চুই চাষের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। ২০১৬ সাল থেকে তার ‘চুই নার্সারি’ পরিচালিত হচ্ছে, এবং তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার চারা বিক্রি করেছেন, যার প্রতিটি ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে তার নার্সারিতে এক লাখের মতো চারা রয়েছে।
নবদ্বীপ বলেন, “আমি দেশের ৬৪টি জেলার মানুষকে চুই চারা পাঠিয়েছি। অনেকে এখন নিজস্ব নার্সারি খুলে সাফল্য পাচ্ছেন।”
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর চাকরির জন্য বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হন নবদ্বীপ। পরবর্তীতে এমএলএম কোম্পানিতে কাজ শুরু করলেও তা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি হতাশ হন। ঠিক সেই সময় একজন কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে তিনি চুই চাষে মন দেন। শুরুতে কিছুটা কষ্ট হলেও এখন তার আয় বছরে ২৫-৩০ লাখ টাকা, শুধুমাত্র চুই ও চারা বিক্রি করে।
তার তৈরি ‘এনপিএন এগ্রো এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি চমৎকার নার্সারি এখন খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে। এখানে তিনি মাসে ১-১.৫ লাখ টাকার চারা এবং ১.৫-২ লাখ টাকার চুই বিক্রি করেন। প্রতি চারা ৪০-৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি চুই ১০০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হয়।
তিনি ৪ জন কর্মচারী (২ জন পুরুষ, ২ জন নারী) রেখেছেন, যাদের মোট মাসিক বেতন ২৫-৩০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “চাকরির পেছনে না ঘুরে এখন আমি নিজেই কর্মসংস্থান তৈরি করেছি। এভাবেই আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।”
একই গ্রামের মেচোঘোনা গ্রামের আতিয়ার রহমান জানান, মাত্র ২-৩ শতাংশ জমিতে চুই চাষ করে ৩-৪ বছরের মাথায় প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব।
বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে চুই চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুধু ডুমুরিয়া নয়, আশপাশের গ্রামেও ছোট-বড় অনেক নার্সারি গড়ে উঠেছে। অনেক শিক্ষিত তরুণও এ খাতে যুক্ত হচ্ছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনসাদ ইবনে আমিন জানান, “চুই গাছের কান্ড মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর চাষে কৃষি দপ্তর সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।”
চুই শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায় না, এর শিকড়, কান্ড, পাতা, ফুল ও ফল ওষধিগুণে সমৃদ্ধ। বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় ১৩০ হেক্টর জমিতে চুই চাষ হচ্ছে এবং এতে প্রতি বছর ৩৭৪ মেট্রিক টন চুই উৎপাদিত হচ্ছে। এই চার জেলায় প্রায় ৪ হাজার কৃষক চুই চাষে যুক্ত রয়েছেন।
চুই মূলত মাংস রান্নায় ব্যবহার হলেও অনেকে মাছ ও সবজিতেও ব্যবহার করেন। এমনকি স্ট্রিট ফুডেও এর ব্যবহার দেখা যায়। এর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে খুলনায় গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫০টির বেশি চুই নির্ভর রেস্টুরেন্ট।
চুকনগরের আব্বাস হোটেল বিশেষ করে চুই মাংসের জন্য বেশ বিখ্যাত। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ খুলনায় এসে এসব খাবারের স্বাদ নিতে ভিড় করছেন।
চুই কাটার জন্য উঁচু জমি উপযুক্ত এবং বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন-কার্তিক মাসে এটি রোপণ করা উত্তম। বর্তমানে প্রতি কেজি চুই ৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
খুলনা অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “চুইঝাল দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনাময় একটি কৃষি পণ্য। এর ওষুধিগুণের কারণে চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।”
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত