ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা খুলনা। এ জেলায় রয়েছে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের এক গৌরবময় ইতিহাস। সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ, সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং হযরত খান জাহান আলী (রা.) ছিলেন এ অঞ্চলের মুসলিমদের আশার আলো । তাদের হাত ধরে বৃহত্তর খুলনায় তৈরি হয়েছে ইসলামের এক বিরাট কাফেলা। সেসময় শিক্ষা, দীক্ষা, বিচারকার্য , শাসনকার্য থেকে শুরু করে মহান আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করা সবকিছুই ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক। এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মুসলিম শাসনকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এ মসজিদগুলোর নির্মাণ কৌশল যেমন চমৎকার তেমনি স্থাপনা শিল্পেও রয়েছে ভাব ও গাম্ভীর্যের ছাপ । সময়ের পরিক্রমায় এসব মসজিদ এখনও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে টিকে আমাদের মাঝে। তবে বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে খুলনা জেলায় মোট মসজিদের সংখ্যা ১ হাজার ৩শত ৭৪টি। তার মধ্যে প্রাচীন মসজিদের সংখ্যা ৯ টি।
খুলনা মহানগরী থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রা উপজেলায় আমাদী গ্রামে মসজিদকুড় মসজিদ অবস্থিত। এটি নির্মাণ করেছিলেন হযরত খানজাহান আলীর (র.) একান্ত সহচর হযরত বুড়ো খাঁ (র.)। তিনি ধর্ম প্রচারের সাথে রাজ্য শাসন ও জমি পত্তন করতেন। মসজিদটি সুন্দরবনের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এটি বর্গাকার। এর প্রত্যেক বাহুর দিকে ৫৪ ফুট ও ভিতরের দিকে ৪০ ফুট লম্বা। মসজিদের তিনটি প্রবেশপথ আছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। আছে চারটি মিনার। মসজিদটির বাইরের দেয়ালে দক্ষিণ পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়া মাটির চিত্র ফলকের দ্বারা অংকিত ছিল। মসজিদের মধ্যে ৪টি প্রস্তর স্তম্ভ আছে। আরো আছে ৯টি গম্বুজ। গম্বুজের নির্মাণ কৌশল খুবই চমৎকার।আরশ নগরের মসজিদ।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আরশনগর গ্রামে একটি মসজিদ আছে। মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ইংরেজি ১৫০০ সালে। যতদূর জানা যায়, এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন পিরে কামেল শেখ শাহ আফজাল (র.) তিনি হযরত খানজাহান আলীর (র.) সাথে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মসজিদটি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে ধ্বংস স্তুপ থেকে মসজিদটি উদ্ধার করে সংস্কার করা হয়। মসজিদের ভিতর থেকে একটি শিলা লিপি উদ্ধার করা হয়। তাতে একটি হাদিস লেখা আছে। বর্তমানে শিলা লিপিখানি রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
কয়রা উপজেলায় বেতকাশি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (র.) সময়ে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার একান্ত সহচর হযরত খালেক খাঁ (র.) মসজিদটি কারুকার্য খচিত করে নির্মাণ করা হয়েছিল।সোলায়মান পুরের মসজিদ : পাইকগাছা উপজেলায় সোলায়মানপুর গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (র.) আমলে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার সাথে আসা এক শিষ্য হযরত বোরহান উদ্দিন খান (র.)। মসজিদটি খুবই সুন্দর ছিল।
রূপসা উপজেলার আলাইপুরে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি দেখতে খুবই চমৎকার। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক ইতিহাস এখনো অনুদঘাটিত। তবে এটি খানজাহান আলীর (র.) সময় নির্মিত হয়েছে বলে বিজ্ঞজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার চিংড়া গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। অনেকের ধারণা এ মসজিদটিও খানজাহান আলীর (র.) সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এ মসজিদ নিয়ে অনেক অলৌকিক কথা শোনা যায়।
খুলনা মহানগরীর সবচেয়ে পুরানো মসজিদ টাউন জামে মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। এটি ভৈরব নদের পাড়ে কেডি ঘোষ রোডের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর।
নগরীর টুটপাড়া বড় পুরানো জামে মসজিদটি ১৮৮০ সালে নির্মিত হয়। এ মসজিদটি দেখতে খুব সুন্দর।
নগরীর সবচেয়ে আধুনিক মসজিদ হচ্ছে বায়তুন নূর মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদটি ১৯৮০ সালের ২২ নবেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলামকে সভাপতি করে এই মসজিদ নির্মাণের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এস. এম মোস্তাফিজুর রহমান মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ মসজিদে এক সাথে ৬ হাজার মুসল্লি নামায আদায় করতে পারেন। মহিলাদের জন্যও মসজিদটিতে আছে আলাদা নামাযের স্থান। এছাড়া মসজিদটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আছে মাদরাসা ও ইসলামী পাঠাগার। মসজিদটির মিনার ১৩৮ফুট উচ্চতা।
অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত মসজিদটি খুলনা শহরে অবস্থিত। মসজিদটির ভেতরের এবং বাইরের সৌন্দর্য সহজেই নজর কাড়বে যেকোনো মানুষের। রাতের বেলার কৃত্রিম আলোয় চারপাশের পরিবেশ দেখে মনে হয় জান্নাতের একটি সুসজ্জিত বাগান। এই যেন দুর্লভ উদ্ভিদের এক অসাধারণ সংগ্রহাগার। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদে সহজেই দেখা মিলবে অর্কিড, বনসাই সাইকাস পাইনাসসহ নানা ধরনের শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদের। উদ্ভিদগুলো মসজিদের প্রধান ফটক এবং চারপাশে এমনভাবে সজ্জিত করা রয়েছে, যার প্রেমে পড়বে যে কেউ, যে কোনো সময় প্রেমে পড়ে যাবে। তবে এই মসজিদের প্রধান আকর্ষণ হলো এর সামনে অবস্থিত শাহি গেট। যার সৌন্দর্য এককথায় অসাধারণ। এছাড়া মসজিদটিতে রয়েছে খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় মিনার। উচ্চতায় যার পরিমাণ ২২৬ ফুট। মিনারটি সম্পূর্ণটাই সাদা টাইলসে তৈরি। যার ফলে অনেকদূর থেকে সহজেই মসজিদটির অবয়ব চোখে পড়ে। একটি মিনার ছাড়াও মসজিদটিতে রয়েছে চারটি গম্বুজ।
পিএসএন/এসআই
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত