জাতীয় সংসদে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা সংক্রান্ত নতুন আইন পাস করা হয়েছে। এ বিধান অনুযায়ী, কোর্টের অনুমতি ব্যতীত ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। এ ছাড়া বিচারকাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ এই আইনে যোগ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) রাতে এসব যুক্ত করে ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন অধিবেশনের সভাপতি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এসময় সংসদে বিএনপিসহ বিরোধীদলের বেশিরভাগ সদস্যই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রশংসা করেন। তবে এর কোনো কোনো ধারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তারা।
এই সংশোধনী পাস হওয়ার ফলে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।
বিলে ক্রস এগজামিনেশন বা জেরার সময় জিজ্ঞাসা করার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার ভুক্তভোগীকে তার নৈতিক চরিত্র বা অতীত যৌন আরচণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি আদালত মনে করে এই ধরনের প্রশ্ন করা প্রয়োজন, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়েই কেবল তা করা যাবে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ঔপনিবেশিক আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
এ ছাড়া সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও নতুন ধারা যুক্ত করে মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনেরও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে, আদালত যদি মনে করে যে কোথাও আপত্তিজনক কিছু আছে অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য-প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে।
এই আইন পাসের আলোচনায় অংশ নেন বিএনপি থেকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, এই আইনের খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইনটা কার হাতে থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। দেখা যায়, সে আইনটি ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে। এটি ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ফেসবুকারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডেটা সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে, এটি মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘ্নিত করবে।
বিএনপির এই সংসদ সদস্য আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল রেকর্ড সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। কারণ এখন ‘ডিপ ফেক’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজনের ছবির জায়গায় আরেকজনের ছবি ব্যবহার করে ভিডিও তৈরি করা যায়।
দেশে দীর্ঘদিনে মামলার যে জট লেগে গেছে সেটা ছাড়ানো সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জেলা কোর্টগুলোতে গেলে মনে হবে হাটবাজার বসছে। মানুষের ভিড়। দেওয়ানী মামলা পিতা রুজু করলে সন্তানও তার রায় দেখে যেতে পারেন না। আইনমন্ত্রী, ভূমি সচিবের সহায়তায় একটি মামলায় ৬৫ বছর পর আমরা এক লাখ মানুষ নিষ্কৃতি পেয়েছি। মামলাজট নিরসনে তিনি শালিসি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করেন।
মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে যারা মামলা করছে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান বিএনপির হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, অপরাধীদের শাস্তির জন্য নানা আইন করা হচ্ছে। যারা মিথ্যা তথ্য ও সাক্ষ্য দিয়ে মামলা দায়ের করছে। তাদের বিচারে দ্রুত বিচার আইন করার দাবি করেন।
হারুন বলেন, বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করছে। তাদের এই মামলার কারণে আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিদেশে থাকার পরেও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান কি না মন্ত্রীর কাছে সেই প্রশ্ন রেখে বিএনপির এই সদস্য বলেন, দেশে আইনের শাসন না থাকলে যতই ভালো আইন করি না কেন কাজে আসবে না।
বিরোধীদের সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই আইনের একটি ধারা ছিল নারীদের জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। তা সংশোধন করা হচ্ছে যা নারীদের জন্য সম্মানজনক দেশের জন্য সম্মানজনক।
মিথ্যা অভিযোগে মামলার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, মিথ্যা অভিযোগে মামলা হতে পারে। কিন্তু কেউ মিথ্যা অভিযোগে মামলা করলে আইনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করারও সুযোগ আছে। এখন আইনের মাধ্যমেই দেশ চলছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত