এখন ধানের ভরা মৌসুম। কৃষকরা মোটামুটি ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত। গোলা ভরার পাশাপাশি বাজারেও উঠতে শুরু করেছে আমন জাতের নতুন ধান। দামের দিক দিয়েও পুরোনো ধানের মতোই দাম। ঠিক যে সময়ে বাজারগুলোতে নতুন ধান পাওয়া যাচ্ছে তখন বাড়তে শুরু করেছে চালের বাজার। দাম বাড়ার পেছনে নানা অজুহাত থাকলেও ক্রেতা ও ছোট ব্যবসায়ীরা এই সময়ে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়াকে অযৌক্তিক বলছেন।
দিনাজপুরের খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দিনাজপুরে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের মূল্য ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা।
চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, দাম বৃদ্ধির ফলে চালের বেচাকেনাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মোটা চালে, তবে বাদ যায়নি চিকন চালের দামও। এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মিলাররা বলছেন, এখনও বাজারে পুরোদমে মোটা জাতের ধান পাওয়া যাচ্ছে না, যা পাওয়া যাচ্ছে চিকন জাতের ধান। ফলে চালের দাম বেড়েছে।
দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় চালের পাইকারি বাজার বাহাদুরবাজার এনএ মার্কেটে গিয়ে জানা যায়, বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩০০০ টাকা, মিনিকেট ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা, বাসমতী বা বাংলামতী ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকা, নাজিরশাইল ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৮৫০ টাকা, গুটিস্বর্ণা ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, বিআর-২৯ ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৬৫০ টাকা, সুমন স্বর্ণা ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা, রঞ্জিত ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকা, সিদ্ধ কাটারি প্রকারভেদে ৫ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৫ হাজার ৮০০ টাকা এবং হাইব্রিড (মোটা চাল) বিআর-১১ জাতের চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে।
অথচ এক সপ্তাহ আগেও ২৮ জাতের চাল ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৮৫০ টাকা, মিনিকেট ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা, বাসমতী বা বাংলামতী ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা, নাজিরশাইল ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার ৭৫০ টাকা, গুটিস্বর্ণা ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা, বিআর-২৯ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকা, সুমন স্বর্ণা ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, রঞ্জিত ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৪৫০ টাকা, সিদ্ধ কাটারি ৫ হাজার ৫৫০ থেকে ৫ হাজার ৭০০ টাকা এবং বিআর-১১ ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
এক সপ্তাহের মধ্যে ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা দাম বাড়ায় চাল ক্রেতা মকসেদুল ইসলাম বলেন, আমি তো ভ্যান চালিয়ে সংসার নির্বাহ করি। চালের যে দাম তাতে কিনে খাওয়া দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। সরকার কম দামে যে চাল দিচ্ছে তাতে করে দীর্ঘলাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি উপার্জন করব।
রবিউল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহে যে চাল ৪৩ টাকা দরে কিনেছি সেই চালের দাম এখন ৪৫ টাকা। আমাদের কথাও একটু ভাবা দরকার।
বাহাদুর বাজারের চাল ব্যবসায়ী এরশাদ হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ আগে যে দাম ছিল তা এখন বেড়ে গেছে। মিলাররা চাল সংকটের অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করেছে। আমাদেরও সেই দামে চাল ক্রয় করতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রেতারাও নানা কথা বলছেন। বেচাবিক্রিও কমে গেছে। কিন্তু আমাদের তো আর কিছুই করার নেই।
ধান-চাল ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ জানান, ধান সবেমাত্র উঠতে শুরু করেছে। এখনও পুরোদমে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এক ধরনের সংকটের কারণে নতুন চাল করা যাচ্ছে না। এ জন্য দাম কিছুটা বেড়েছে।
তবে চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন একশ্রেণির মজুতদাররা। যাঁরা ব্যবসায়ী না হয়েও অবৈধভাবে ধান ও চাল মজুত করে রেখেছেন। জেলার বিভিন্ন হাসকিং, অটো রাইস মিল, বিভিন্ন গোডাউনে ধান-চাল মজুত করে রাখছেন ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা আরও বলেন, এবারে ধানের উৎপাদন খরচ বেশি। প্রথম দিকে জমিতে সেচ দিয়ে চারা রোপণ করতে হয়েছে। সেখানে খরচ বেশি হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় তেলের দাম বাড়ায় ও সারের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে এবারে সেই উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে কৃষকরা বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন। এর প্রভাব চালের মধ্যে আসছে বলেও অভিমত অনেকের।
বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, এখন মাঠে ধান। অনেক ধানই কাটা-মাড়াই হয়ে গেছে। এ সময়ে ধানের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। ধানের দাম বাড়লে চালের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকার নির্ধারিত ডলারের মূল্য মানছে না। ফলে অতিরিক্ত ডলারের মূল্য দিয়ে চাল আমদানি করতে হচ্ছে এবং আমদানিকারকদের তা পোষাচ্ছে না। এ কারণে আমদানিকারকরা আগ্রহ হারিয়েছেন।
দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন বলেন, অযৌক্তিক কারণে চালের দাম যাতে করে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চালের দাম কিছুটা বাড়লেও বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান এলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
পিএসএন/এমঅাই
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত