
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যার সৃষ্টি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশে। নিজের গড়া সেই ট্রাইব্যুনালেই আজ ফাঁসির রায় ঘোষণা হলো স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনালের আনা মোট পাঁচ অভিযোগের দ্বিতীয়টিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথম অপরাধে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করেছেন। অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এই মামলার অন্য দুই আসামি হলেন- পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
মানবতাবিরোধ অপরাধের এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাজসাক্ষী হওয়ায় আরেক আসামি আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন ১৫০০ এর বেশি ছাত্র-জনতা পুলিশ বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর ক্যাডারের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। যার মধ্যে ৩০ জনের বেশি শিশুও ছিল। এসব শিশুরা কেউ রাস্তায় খেলতে এসে, কেউ বাড়ির ছাদে, আবার কেউ ঘরের ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
শুধু সরকারি হিসেব এবং তদন্তে নয়, জাতিসংঘের দীর্ঘ অনুসন্ধান এবং সংস্থাটির দেওয়া প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের এই গণহত্যার চিত্র।
এও উঠে এসেছে, গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সরাসরি নির্দেশ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দায়িত্বে থেকে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। বৃষ্টি মতো চলে গুলি, সারাদেশের সড়কে লাশ পড়তে তাকে শয়ে শয়ে।
ওই সময়ের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে ঢাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে বলছিলেন, ‘স্যার, গুলি করি, পড়ে একটা যায় একটা, বাকিডি যায় না। এইডাই স্যার বড় আতঙ্কের বিষয়।’
এই ঘটনা গোটা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। তারই মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট সেবা। গোটা দেশকে অন্ধকারে রেখে চালানো হয়েছিল গণহত্যা। খালি হয়েছে বহু মা-বাবার বুক। বাবা হারিয়েছে অনেক শিশু। বিধবা হয়েছে শতশত নারী।
অবশেষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন স্বৈরাচারি শাসক শেখ হাসিনা। গত ১৫ মাস দিল্লিতে রয়েছেন তিনি। এদিকে দেশে তার বিরুদ্ধে হয়ে গেল ফাঁসির রায়।
যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হলো, সেটিতে প্রথম অভিযোগপত্র জারি করা হয় ২০১০ সালে। গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ৫৭টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে।
এর মধ্যে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ছয়জনের। যাদের মধ্যে পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং একজন বিএনপির।
গত বছর হাসিনা সরকারের পতনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করে অন্তর্র্বতী সরকার। যেখানে হাসিনা ছাড়াও তার সময়ের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী এবং আমলাদেরও বিচার হচ্ছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত