বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পরও এ বিষয়ে কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উল্টো তাদের বক্তব্যে হতাশ ফারদিনের সহপাঠী ও বাল্যবন্ধুরা। তারা বলছেন, যেসব কথা বলা হচ্ছে ও সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে তার সাথে ফারদিনের বাস্তব জীবনের কোনো মিল নেই।
তাদের ভাষ্য, ফারদিন যা ছিল না তা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর ফলে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তাদের।
সহপাঠীদের চোখে ফারদিন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ী ও মুক্তচিন্তার মানুষ। যার কোনো ধরনের নেশা ছিল না। ছিল না কোনো মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও বিতার্কিক হিসেবেই বেশি পরিচিতি ছিল ফারদিনের। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল না তার। ফারদিন বিতর্ক ক্লাবের পাশাপাশি বুয়েট রেডিওতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ক্যাম্পাসের এই রেডিওতে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন।
তার বাল্যবন্ধু ও ক্যাম্পাসের সহপাঠীরা জানিয়েছেন, ফারদিন কখনোই কোক (কোমল পানীয়) খেত না। এটা যে ক্ষতিকর সে ব্যাপারে তিনি অন্যরকম সচেতন ছিলেন। ফলে অন্যদেরও এই পানীয় পানে নিরুৎসাহিত করতেন। ফারদিন সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারতেন না। সবকিছু যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করতেন। এজন্য ফারদিন প্রচুর পড়াশুনাও করতেন বলে জানিয়েছে তারা।
তারা জানান, ফারদিনের সঙ্গে ক্যাম্পাসে কারও কোনো ধরনের বিরোধ ছিল না। তিনি বন্ধুদের সাথে ছাড়া সিনিয়রদের সাথে মিশতে তেমন একটা স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন না। ক্যাম্পাসে তার বন্ধু ছিল হাতেগোনা। বন্ধুদের আড্ডায় মেয়েলি কোনো গল্প উঠলে এড়িয়ে যেতেন। সবসময় ভিড় ও ঝামেলা এগিয়ে চলতেন।
তার খুব কাছের বন্ধুরা জানিয়েছেন, ফারদিন সারাদিন পড়াশোনা, বিতর্ক ও টিউশনি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এর বাইরে ক্যাম্পাসে সচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচি থাকলে তাতে অংশ নেয়ার চেষ্টাও ছিল তার। মুক্তচিন্তার অধিকারী ফারদিন ক্যাম্পাসে বিনোদনের অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বিতর্ক ক্লাব ও চর্চাকে। বিতর্ক ক্লাবে বেশ সক্রিয় ছিলেন ফারদিন। বিদেশে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাওয়ার কথাও চলছিল। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
ফারদিনের বাড়ি রাজধানীর খুব কাছে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবন সেভাবে কাটেনি। তবে মাঝেমধ্যে রশিদ হলে থাকতেন তিনি। সেটিও স্থায়ীভাবে নয়। অন্যের সাথে সিট শেয়ার করতেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া রাত জাগতেন না। সকাল সকাল উঠতেন ও সকালে হাঁটতে বের হতেন ফারদিন। অন্যকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
ফারদিন পড়াশুনা করতেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। এই বিভাগের সহপাঠী মাসিয়াত জেরিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে করছি। সে নিখোঁজের পর প্রথম দিকে তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে- এমন সংবাদে প্রকাশ করাটা একটা প্রপাগাণ্ডা ছিল বলে মনে হয়েছে। তার মতো একজন মুক্তমনা ছেলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার তো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ বা ক্যাম্পাসে তাদের রাজনীতি করতে না দেয়ার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন সেজন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে- এটাও বিশ্বাস করি না। ও (ফারদিন) আসলে ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের দাবিতে ভোকাল ছিল না। যেহেতু ফারদিন ডিবেট করতো সে কারণে ভালো-মন্দ বুঝতো। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে চলা আন্দোলনগুলোতে সে চিহ্নিত হওয়ার মতো কেউ ছিল না।
তিনি আরও বলেন, একটা ছেলে সিগারেট পর্যন্ত খেত না। আর তাকে মাদকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ সত্যি কষ্টদায়ক। ও যা নয়, তা বাড়িয়ে বলাটার মানে হলো ওর প্রতি অসম্মান করা।
গত নভেম্বরে ফারদিনের এক কাছের বন্ধুর সাথে জেরিনের কথা হয়। তখন সেই বন্ধু জেরিনকে বলেছিল, ফারদিন তাকে জানিয়েছে সে সিঙ্গেল। তিনি বলেন, ফারদিন এমন ধরনের ছেলে নয় যে, সে প্রেম করবে আর আমরা জানব না। সে লুকানোর মতো কিছু করতো না। আর বুশরার ব্যাপারে আমরা যা জানি তা হলো, ডিবেট ক্লাবের সূত্র ধরে বুশরার সাথে পরিচয়। এটা চার বছরের মতো হবে। ওর সাথে কিন্তু দেখা বেশিবার হয়নি। বুশরার সাথে ওর ঘনিষ্ঠ বা মানসিক সম্পর্ক ছিল বা মেন্টাল টানাপোড়েন চলছিল- এ বিষয়টিও সত্য না।
তিনি জানান, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি বেশি জোরালো হয়েছে গত ১৫ আগস্ট ক্যাম্পাসে যখন ছাত্রলীগ প্রোগ্রাম করতে চেয়েছে। তবে এই বিষয়ে অন্যদের মতো ফারদিন দাবি জানালেও প্রথম সারির কেউ ছিল না। সেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিল। এছাড়া বুয়েট ছাত্র আবরাব ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর তার ব্যাচের বন্ধুরা একটি আর্কাইভ বানিয়েছিল। যেটার নাম হলো- আবরাব ফাহাদ আর্কাইভ ডটকম। ফারদিনকে বিভিন্ন মিডিয়ায় এই সাইটের এডমিন হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও তা সঠিক নয় বলে জানান তিনি।
তার সহপাঠীরা বলছেন, র্যাব ও ডিবি পুলিশ দুই ধরনের স্টোরি বলছে। তাদের গল্প কোনোভাবেই মিলছে না। এই জিনিসটা কেন হচ্ছে! হত্যা তো একটিই। তাহলে গল্প দুই ধরনের কেন হচ্ছে তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি প্রশ্ন তাদের। বিষয়টি তাদের মাঝে হতাশার জন্ম দিয়েছে। তারা দুটি সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করার দাবিও জানিয়েছেন।
ফারদিনের সঙ্গে বড় হয়েছেন তারই এলাকার এক বড় ভাই সাজ্জাদ। তিনি ঢাকার বাহিরের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তার কাছে ফারদিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ফারদিনের সাথে কারও কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না। সে কোনো নেশা করতো না। পড়াশুনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতো। তবে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য তাকে খুন বা হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে তা মনে হয় না। কারণ সে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আন্দোলনে সামনের সারিতেও ছিল না।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করছি, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর তাকে নিয়ে যেসব রিউমার ছড়ানো হচ্ছে সেগুলোর সাথে তার কখনোই কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে আমরা বিশ্বাস করি। ফারদিন সারাদিন পড়াশোনা, বিতর্ক ও টিউশনি নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।
একই কথা জানালেন ফারদিনের বাল্যবন্ধু আবু বকর। তিনি তার সাথে কলেজজীবন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। আবু বকব ঢাকা মেইলকে বলেন, যেসব নিয়ে সংবাদ হচ্ছে, সে এসবে জড়ানোর কথা না। সে সিগারেটের ধোয়া পর্যন্ত সহ্য করত না।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত