ফকিরহাটের শুভদিয়ায় শেখ হেলাল উদ্দীন সরকারি কলেজের আয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রবর্তিত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভ‚মিকা ও করণীয় বিষয়ে এক মতবিনিময় সভা আজ ১৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার) বেলা ১২টায় কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন জাতি গঠনে শিক্ষকরাই হচ্ছেন প্রধান নিয়ামক শক্তি। শিক্ষকদের হাতেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়। আর সেই জনশক্তি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন চেয়েছেন এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন। তিনি সে লক্ষ্যেই স্বাধীনতার পর প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেন। বর্তমান সরকার ‘৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর গৃহীত নানামুখী কর্মকান্ডে দেশের শিক্ষা সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তননের সূচনা করে। বিএনপি সরকারের আমলে দেশের শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ ছিলো ১১হাজার কোটি টাকা। আর বর্তমান সরকারের আমলে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। বিএনপির আমলে শিক্ষিতের হার ছিলো মাত্র ৪৫ শতাংশ। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় তা ৬৮শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য এটা শতভাগে উন্নীত করা।
তিনি বলনে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। দেশ আজ অনেক এগিয়েছে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ,বিদ্যুৎ খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অভাবনীয়। তিনি আরও বলেন বিএনপি সরকারের আমলে মংলা বন্দর নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছিলো, বন্দর অচল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ‘৯৬ সালের নির্বাচনের পর প্রথম কেবিনেট বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বন্দর সচলে পদক্ষেপ নেন এবং দেশের আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের ৫০ভাগ এ বন্দরে খালাস করার নির্দেশনা দেন। ফলে মংলা বন্দর আবার সচল হয়। আজ দক্ষিণা লে পদ্মা সেতুর কারণে যে দৃশ্যমান ব্যাপক উন্নয়ন সূচিত হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার দল এই সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করেছে। তিনি বলেন ষড়যন্ত্র করে লাভ নেই। কারণ, দেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। তারা বুঝে গেছে কাদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন হবে। তিনি বলেন গাজায় ইসরাইলী বাহিনীর নৃশংস আক্রমণে ফিলিস্তিনী ভাতৃপ্রতিম মুসলিম ভাইদের কি অবস্থা। সেখানে গণহত্যা চলছে। অথচ বিএনপি মুখ বন্ধ করে আছে। কাদের চাপে, এর রহস্য কি? সেটাও জনগণ জানে। বর্তমান সরকার কোনো বিদেশি শক্তিকে ভয় করে না। চার মূল নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় দেশ এগিয়ে যাবে।
সংসদীয় এলাকাসহ দক্ষিণা লের উন্নয়নের আরও অনেক দিক উল্লেখ করে তিনি শেখ হেলাল উদ্দীন সরকারি কলেজের আশাব্যঞ্জক উন্নয়নের প্রশংসা করেন এবং নিভৃত জনপদে কলেজটি আলোকিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা বিস্তারে ভ‚মিকা রাখবে বলে আশা করেন। তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে উচ্চশিক্ষা ও গবেণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ও উন্নতির প্রশংসা করেন। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে শিক্ষকদের মুখ্য ভুমিকা পালনের আহবান জানান। শিক্ষায় নতুন কারিকুলা বাস্তবায়নে তারাই প্রথম নিয়ামক শক্তি বলেও তিনি অভিহিত করেন। এর আগে তিনি কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অবকাঠামোর ফলক উন্মোচন করেন।
বাগেরহাট জেলার সকল প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেড় সহ¯্রাধিক শিক্ষকের অংশগ্রহণে এ সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্য রাখেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন। তিনি প্রাচীন মেসোপটিমিয়া, মিশরীয় সভ্যতার সময় থেকে পরবর্তী গ্রিক ও রোমান সভ্যতার সময়কার শিক্ষা ও জ্ঞান বিকাশের ধারা তুলে ধরে পরবর্তী পর্যায়গুলোর সংক্ষিপ্তসারে বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে বলেন সমাজবদ্ধতার লক্ষ্যেই শিক্ষার যে সূচনা তার পরবর্তী ধারায় ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও আইনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় তখন মুখস্ত বিদ্যার প্রাধান্য ছিলো। পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয় দর্শনের। যখন শিক্ষক দাঁড়িয়ে ও ছাত্র বসে শিক্ষার আদান-প্রদান শুরু হয়। ইসলামী রেঁনেসার যুগে অংক, চিকিৎসাবিদ্যা ও অনুবাদের অগ্রগতি তুলে ধরে তিনি বলেন পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। তিনি ইউরোপীয় রেঁনেসা ও শিল্প বিপ্লবে সৃষ্ট পরিবর্তনের ট্রেন্ডে উপ-মহাদেশের পিছিয়ে থাকার কুফল তুলে ধরেন। প্রথম, দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ধারায় আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়ার কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন বিজ্ঞান শিক্ষা থেকেও আমরা দূরে ছিলোম। মধ্যযুগেও আমাদের দেশে সে ধারার পরিবর্তন হয়নি। বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও তা ছিলো মূলত ইংরেজদের শাসন ব্যবস্থার সহায়ক। ইংরেজদের পর ভারত স্বাধীন হলে কিছুটা পরিবর্তন সূচনা হলেও তার পরও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান পিছিয়ে ছিলো।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনতে ড. কুদরত ই খোদা কমিশন গঠন করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। কিন্তু পনেরই আগষ্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তা আর এগোয়নি। তিনি বলেন বর্তমান সরকার ‘৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে নতুন করে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সুচনা করেন। নতুন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। আজ দেশে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে মানসম্মত শিক্ষা আজও সর্বত্র অর্জিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক দূর এগোলেও আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা এখনও যুগোপযোগী ধারায় যুক্ত হয়নি। তিনি বলেন বিএনপি আমলে রাষ্ট্রের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য বাজেট ছিলো৭কোটি টাকা। আর বর্তমান সরকারের আমলে কেবল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট বরাদ্দ সাড়ে কোটি টাকা। সরকার ফলাফলভিত্তিক ও প্রয়োজনমুখী ধারার শিক্ষার জন্যই সিলেবাসে পরিবর্তন এনেছে। এটা যুগোপযোগী। এটা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ট্রেন্ডের সাথে যুক্ত। আমরা যদি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবর্তিত নতুন কারিকুলা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হই তবে আবারও পিছিয়ে পড়বো। তিনি এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মুখ্য ভ‚মিকা পালনের আহবান জানান।
সভায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর অমিত রায় চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোরের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. বিশ্বাস শাহীন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খুলনা অ লের পরিচালক প্রফেসর শেখ হারুনর রশীদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাগেহাটের জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন, এইচএসটিটিআইএর পরিচালক ড. আতিকুল ইসলাম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খুলনা অ লের উপ-পরিচালক খন্দকার রুহুল আমীন। এ মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ফকিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শেখ হেলাল উদ্দীন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা স্বপন দাশ। সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কলেজের অধ্যক্ষ বটুগোপাল দাশ। বক্তারা বলেন স্বপন দাশের প্রচেষ্টায় এক সময়কার সন্ত্রাসী ও দুর্গম জনপদে আজ আলো ছড়াচ্ছে শেখ হেলাল উদ্দীন সরকারি কলেজ। সভাপতি এ কলেজকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে এখানে অনার্স কোর্স চালুর জন্য এলাবাসীর আগ্রহের কথা তুলে ধরেন।
