সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউসসহ কয়েকজনের এক সিন্ডিকেট যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমোদন ছাড়াই আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়েছে, সে অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান।
দুদক মহাপরিচালক জানান, সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে তিনিসহ বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন। এ অভিযোগটি অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান টিম অভিযোগসংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে দুদকের উপপরিচালক রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র, ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে কি না তার কপি, বিদ্যুৎ ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম ও পদবি এবং এ বিষয়ে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকলে তার রেকর্ডপত্র ও এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য ও তা শুল্ক-কর আদায়যোগ্য কি না, প্রযোজ্য হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না এবং শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অনুমতি দিয়েছিল কি না, দেওয়া হয়ে থাকলে এ-সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র বা তথ্যাদি এবং আদানি গ্রুপের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি খতিয়ে দেখতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির তদন্তে উঠে আসে— ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি) শুল্ক-কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৯ মার্চ ঝাড়খন্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তদন্ত কমিটি তদন্তকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অংশ হিসেবে কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিলের প্রমাণ পায়নি। এ ছাড়া তা আইনি পন্থায় নিষ্পত্তি না করার প্রমাণও পায়। এনবিআরকে ছাড়া আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এরপরই বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে এনবিআর থেকে দুদকে পাঠানো হয়।
এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক ও অব্যাহতি দিয়েছে। চুক্তির আওতায় গেল বছরের জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যার মূল্য ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার। এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা এনবিআরের। চুক্তিতে কর অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এটিকে কর ফাঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল চুক্তিতে থাকা শুল্ক-কর অব্যাহতির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে।