ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযান বন্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে চান দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি। এজন্য যদি ক্রিমিয়া দ্বীপ ও সদ্য রুশ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডের দুই দেশ দনেতস্ক ও লুহানস্ক প্রশ্নে আপস করতে হয়, তাতেও রাজি তিনি।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো সম্পর্কে যে ধারণা অতীতে কিয়েভের ছিল, তাতেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে মঙ্গলবার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি আমার দেশ ও জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। ক্রিমিয়া ও ডনবাস রিপাবলিকে (দনেতস্ক ও লুহানস্ককে একত্রে ডনবাস রিপাবলিক বলা হয়) রুশদের পাশাপাশি অনেক ইউক্রেনীয় এখনও বসবাস করেন। আমি আমার নিজের দেশ ও জনগণের পাশাপাশি ওই অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত ইউক্রেনীয়দের নিয়েও উদ্বিগ্ন। এটা ডনবাস নামের ওই ছদ্ম প্রজতন্ত্রের স্বীকৃতির চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ।
‘আমরা এ ব্যাপারে একটি সমঝোতায় যেতে পারি। ক্রিমিয়া ও ডনবাসে বসবাসরত ইউক্রেনীয়দের জান-মালের নিরাপত্তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো ইউক্রেনে ফিরে আসতে চান…অর্থাৎ এসব অঞ্চলের জনগণ ও জনজীবনের নিরপত্তার স্বার্থে আপস হতেই পারে।’
‘তবে আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আমি আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছি, আত্মসমর্পণের জন্য নয়।’
ন্যাটো নিয়েও নিজের নতুন উপলব্ধি সম্পর্কে এবিসিকে জানিয়েছেন জেলেনস্কি। এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বুঝতে পেরেছি, ন্যাটো আসলে ইউক্রেনকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। এই জোট বিতর্কিত কোনো বিষয়ে জড়াতে চায় না এবং রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে যেতে ভয় পায়।’
‘তবে আমরা যে নতজানু হয়ে ন্যাটোর সহযোগিতা চাইব, ব্যাপারটি এমন নয়। ইউক্রেন সে রকম কোনো দেশ নয় এবং আমিও তেমন প্রেসিডেন্ট নই।’
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দ্বন্দ্বের শুরু এই ন্যাটোকে ঘিরেই। কয়েক বছর আগে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে ইউক্রেন। তারপর থেকেই এই ব্যাপারটিকে ঘিরে তিক্ততা শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে।
এর মধ্যে ন্যাটো ইউক্রেনকে পূর্ণ সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করার পর দ্বন্দ্বের তীব্রতা আরও বাড়ে। ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন প্রত্যাহারে ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে গত দুই মাস রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন রেখেছিল মস্কো।
কিন্তু এই কৌশল কোনো কাজে আসেনি। উপরন্তু এই দু’মাসের প্রায় প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অভিযোগ করে গেছে— যে কোনো সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে রুশ বাহিনী।
অবশেষে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই ভূখণ্ড দনেতস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া; এবং তার দু’দিন পর, ২৪ তারিখ ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
মঙ্গলবার ত্রয়োদশতম দিনে পৌঁছেছে এই অভিযান। প্রাণ বাঁচাতে ইতোমধ্যে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় প্রায় ২০ লাখ ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ দিনের সামরিক অভিযানে ইউক্রেনে সাড়ে সাড়ে ৪ শ’র বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুও।
এদিকে, ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর থেকে বেলারুশের গোমেল শহরে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন রাশিয়া ও ইউক্রেন সরকারের প্রতিনিধিরা। সোমবার তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে।
সেই বৈঠকে চলমান অভিযান বন্ধে কিয়েভকে কিছু শর্ত দিয়েছে মস্কো। এগুলো হলো—ইউক্রেনকে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভূখণ্ডের অংশ বলে স্বীকার করতে হবে এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
এসব শর্ত দেওয়ার এক দিনের মধ্যেই এবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।