ইরানকে থামানো না হলে খুব কম সময়ের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে, ইরানে এবারের হামলা শুরুর কারণ হিসেবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই মন্তব্য করেন। এটা এক বছরও হতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেও হতে পারে, হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অবশ্য নেতানিয়াহু এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে বা তৈরির দ্বারপ্রান্তে এমন অভিযোগ এর আগেও বেশ অনেকবার তোলা হয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাজা রেজা খান বা রেজা শাহ পাহলভির হাত ধরে। এটা ঘটে মূলত ষাটের দশকের দিকে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় আমেরিকা সহযোগিতাও করতো।
আমেরিকার সহযোগিতায় ১৯৬৭ সালে তেহরান পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র চালু করা হয়। অবশ্য পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ না করার নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে ১৯৬৮ সালে স্বাক্ষর করে ইরান।
তবে যে ইরান আমেরিকা ও ইসরায়েলের বন্ধু ছিল সেটা বদলে যায় ১৯৬৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। অনেকে ধারণা করেন আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের কার্যক্রম শুরু করে।
১৯৮৪ সালে চীনের সহযোগিতায় ইরানের ইসফাহানে সর্ববৃহৎ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র চালু করা হয়। যদিও ইরান সবসময়ই বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাতে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের কথা বলে এসেছে।
তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রকাশ্যে আসে ২০০২ সালে; যখন নির্বাসিত একটি বিরোধী দল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র এবং একটি ভারী পানি চুল্লি নির্মাণের গোপন কার্যক্রমের তথ্য প্রকাশ করে। যদিও এর আগে থেকেই ইরানের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লব ও আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনির প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাসের মাথায় একদল শিক্ষার্থী তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের দখল নিয়ে ৫২ জন আমেরিকানকে জিম্মি করে। এর প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ইরান।
এরপর আশি ও নব্বই দশকজুড়ে নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ানো হয় যেন ইরান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কর্মকাণ্ডে সমর্থন ও রাসায়নিক, জৈবিক, বা পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষমতা বা উন্নত প্রচলিত অস্ত্র সমৃদ্ধের চেষ্টা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এত আগে থেকেই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়টি আমেরিকা ও ইসরায়েলের আলোচনায় এসেছে। ১৯৯২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ইরান-ইরাক আর্মস ননপ্রোলিফারেশন অ্যাক্ট বা অস্ত্র বিস্তার রোধ আইন পাস করা হয়।
সেখানে বলা হয়, ইরাক বা ইরানে পণ্য বা প্রযুক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে যখন মনে হবে সেগুলো সেই দেশের রাসায়নিক, জৈবিক, পারমাণবিক বা উন্নত অস্ত্র অর্জনে অবদান রাখতে পারে, এর বিরোধিতা করা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন দেয় কংগ্রেস। সেসময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ।
অন্যদিকে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুর দিক থেকে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন।
১৯৯২ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে ইসরায়েলের নেসেট বা সংসদে ধারণা দেন তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলতে পারে। আল জাজিরা, টিআরটি এমন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ তথ্য তুলে ধরেছে। ১৯৯৫ সালে নেতানিয়াহুর বই ফাইটিং টেররিজমেও একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়।
অর্থাৎ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন কথা বলে আসছেন নেতানিয়াহু।
১৯৯৬ সালেও ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটলে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নেতানিয়াহু ইরান ও বিচ্ছিন্ন করার এবং বিপর্যয়কর পারমাণবিক ক্ষমতা বিকাশ থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টায় ইউরোপ ও এশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। এ নিয়ে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে বলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও আসে। ইরান যেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র সমৃদ্ধ করতে তহবিল যোগাতে না পারে সেজন্য মার্কিন কংগ্রেস ইরান-লিবিয়া নিষেধাজ্ঞা আইন পাস করে, যা পরবর্তীতে ইরান নিষেধাজ্ঞা আইন নামে পরিচিত।
এর মধ্য দিয়ে ইরানের পেট্রোলিয়াম শিল্পে বিনিয়োগের জন্য সংস্থাগুলোকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে এবং বলা হয় ইরানের তেল বা গ্যাস খাতে বছরে ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য।
যদিও ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিবাদের পর ২০১০ সাল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর করা হয়নি। তবে বিল ক্লিনটন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইরানে বা ইরান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমস্ত পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি নিষিদ্ধ করার জন্য নির্বাহী আদেশ জারি করেন।
• শূন্য দশক
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রায় সবসময়ই ছিল। এনিয়ে নানা ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতাও ছিল।
২০০১ সালে ইউএস গভর্নমেন্ট রিফর্ম কমিটির জন্য দেয়া এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, ইরান ও ইরাকের মতো সরকারগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে এবং তাদের গণবিদ্ধংসী অস্ত্র থেকে নিরস্ত্র করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সক্ষমতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
২০০২ সালেও মার্কিন কংগ্রেশনাল কমিটিতে একই কথা বলেন তিনি।
২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাক, ইরান এবং উত্তর কোরিয়াকে অ্যাক্সিস অব ইভিল বা অশুভ অক্ষ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং এই দেশগুলোতে উন্নত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করেন।
সেবছর আগস্টে যখন ইরানের দুটি জায়গায় গোপন পারমাণবিক তৎপরতার কথা সংবাদ সম্মেলন করে জানায় ইরানের নির্বাসিত একটি দল তখন এটি আবার আলোচনার সৃষ্টি করে। ডিসেম্বর নাগাদ স্যাটেলাইট ছবিতেও দুটি নতুন জায়গায় কিছু স্থাপনা দেখা যায় যেগুলো নিয়ে সন্দেহ করা হয়েছিল।
ইরান যদিও তখন জানায়, তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো উদ্দেশ্য নেই এবং সেগুলো শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। মার্কিন তথ্য অনুযায়ী, অবশ্য ২০০৩ সালে পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধ করে ইরান।
২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইরানের সাথে পণ্য, পরিষেবা এবং প্রযুক্তির বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়।
২০০৯ সালে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল ইসরায়েল সফরে গেলে নেতানিয়াহু তাদের বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে এক থেকে দুই বছরের দূরত্বে রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করে উইকিলিকস।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের উল্লেখ করে ২০১০ সালে কংগ্রেস ইরানের তেল রপ্তানি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
• ২০১১ থেকে বর্তমান
গত কয়েক দশকে নেতানিয়াহু বহুবার ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন।
তবে এ নিয়ে সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্যটি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন জাতিসংঘ সদর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় একটি বোমার কৃত্রিম ছবি নিয়ে যান। সেখানে তিনি বলেন, বর্তমান হারে চললে আগামী বসন্তের মধ্যে, সর্বোচ্চ আগামী গ্রীষ্মের মধ্যে, তারা মাঝামাঝি পর্যায়ে সমৃদ্ধকরণ শেষ করবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে।
সেসময় ইরানকে থামাতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে একই বছরের মার্চে ওয়াশিংটনে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি) লবি গ্রুপকে তিনি বলেন, আশ্চর্যজনকভাবে, কিছু মানুষ স্বীকার করতে চায় না যে ইরানের লক্ষ্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা।
২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হাসান রুহানি যিনি দেশের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এরপর বহু আলোচনা, দর কষাকষির মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালে বিশ্বশক্তিগুলো ইরানের সাথে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড সীমিত করার বিষয়ে চুক্তিতে পৌঁছায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং জার্মানির সাথে জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের আওতায় ইরান এতে সম্মত হয়।
তৎকালীন ওবামা প্রশাসনের মতে, ২০১৫ সালের জুলাইয়ের আগে ইরানের কাছে আট থেকে দশটি বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং সেন্ট্রিফিউজ ছিল।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরা সেই সময় অনুমান করেছিলেন যে ইরান যদি তাড়াহুড়ো করে বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি হতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
চুক্তির পর ২০১৬ সালে যাচাই করে আন্তর্জাতিক পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ বা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা যাচাই করে ইরান প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে বলে জানায়। অবশ্য ২০১৮ সালে সে চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বাইডেন প্রশাসনের সময়ে আবারও চুক্তির বিষয়টি আলোচনা এলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। এরপর থেকে আবারও ইরান পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ করছে এমন অভিযোগ আসতে থাকে। এবারের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বলেছেন, আমি মনে করি তারা (ইরান) খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। যদিও এ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিয়ে অকাট্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।