ইদুল আজহাকে সামনে রেখে পশু জবাইয়ের সরঞ্জাম প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন খুলনার কামারশালার কারিগররা। সারাবছর কাজের চাপ কম থাকলেও কোরবানি ইদকে ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে তাদের। লোহার তৈজসপত্রের কাঁচামাল, কয়লার দাম নিয়ন্ত্রনে থাকায় এ বছর কুরবানি ইদের সময়টায় ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশা করছেন তারা।
ঈদুল আজহা আসার মাস খানেক আগে থেকেই ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায় কামারশালাগুলোতে। কাজ চলে ঈদের আগের শেষ রাত পর্যন্ত। কারিগরদের যেন দম ফেলারও সময় নেই। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কাজ। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দ্বিগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় তাদের।
খুলনা শহরের কামারশালাগুলোতে দারুন ব্যস্ততায় সময় পার করছেন কামাররা। অথচ প্রায় সারা বছরই তাদের কাটে অলস সময়। শহরের বড়বাজার, থানার মোড়, খালিশপুর, দৌলতপুর কামারপট্টি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আগুনের লোহায় হাতুড়ির বাড়ি আর ছেনির টোকায় সরগরম কামারদের দোকানগুলো। কারিগরদের চোখেমুখে ক্লান্তি থাকলেও কোরবানির ঈদকে ঘিরে কাজের ব্যস্ততায় প্রাণচাঞ্চল্যতা লক্ষ্য করা গেছে।
দৌলতপুর মহসিন মোড় এলাকার দোকানদার বাবলু কর্মকার বলেন, “ঈদুল আজহার আর বেশিদিন বাকি নেই। ঈদকে সামনে রেখে আমাদের দম ফেলার সময় নেই। এক মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করেছি। এখন গভীর রাত পর্যন্ত প্রায় সব কামাররা একনাগাড়ে কাজ করছে।”
একদিকে কোরবানির পশু কেনায় ব্যস্ত স্বচ্ছল পরিবারগুলো, অন্যদিকে প্রায় কয়েকগুণ বেশি হারেই দা, বটি, ছুরি কিংবা কোরবানি পশু কাবু করার অস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কামাররা।
দোকান ভাড়া, দোকানে পণ্য সামগ্রির জন্য খরচ করা পুঁজি, সব কিছু নিয়েই কোরবানির ঈদের জন্য একান্ত চিত্তে অপেক্ষার প্রহর গুণে কামার দোকানের কর্মচারীরা। পুরো বছর সেভাবে ব্যস্ততা না থাকলেও নিম্ন আয়ের এসব মানুষ অপেক্ষায় থাকেন প্রতি বছরের কুরবানি ইদের সময়টাতে ভালো উপার্জনের।
দোকানিরা বলছেন, ঈদ ঘনিয়ে আসায় তাদের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। আগে হয়তো সকাল ১০টায় দোকান খুলতো। রাত গড়াতেই দোকান বন্ধ করা হতো। তবে ঈদ মৌসুমে সকাল ৮টা থেকেই তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয় আর চলে মধ্য রাত পর্যন্ত। এমনকি ঈদের আগের রাতেও তারা সারারাত পর্যন্ত জেগে কাজ করতে হয়। এ সময়ে কিছুটা মোটাদাগে ইনকাম কমবেশি সবারই হয়।
জানা যায়, সব কিছু মিলিয়ে ঈদ মৌসুমে ছোটখাটো এসব কামারশালাগুলোর আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মতো। তবে দিন প্রতি তাদের ৩-৬ হাজার টাকার মতো উপার্জন হয়। অনেকের আবার এর চেয়ে কম বা বেশিও হয়ে থাকে।
খুলনার বড়বাজারের দোকানদার বিপ্লব কর্মকার বলেন, ঈদুল আজহার আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি। এখন তড়িঘড়ি চলছে কোরবানির প্রস্তুতি। প্রতিটি ছোট ও বড় ছুরি ধারালো করার কাজে কামাররা মজুরি নিচ্ছেন ৩০-৫০ টাকা। কেউ কেউ ৫০-১০০ করেও নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। আবার একটি বটি কিনতে ক্রেতাদের ৩০০-৪০০ টাকার অংক গুনতে হয়। ছুরি আকার ভেদে ৫০- ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আর বড় ছুরি কিনতে লাগে ৬০০-৭০০টাকা। এসব ধারালো সামগ্রী মধ্যে ওজন ও প্রকারভেদে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। দা প্রতিটি ৩শত থেকে ৬ শত টাকা বিক্রয় করছি আমরা।
খুলনার থানার মোড় এলাকা অন্যতম ব্যস্ত এলাকা কামারপট্টির জন্য, প্রায় সব কামারের দোকানেই লোহার সামগ্রী থরে থরে সাজানো। ক্রেতাদের অনেকে আবার নিজস্ব ধাতব পদার্থ নিয়ে আসছেন দা-বটি তৈরি করতে। কেউবা নিচ্ছেন কিনে। তবে দা বটির চাহিদা থাকে সারা বছরই।
দোকানদার রুবেল কর্মকার বলেন, কোরবানি ঈদের আগ মুহুর্তে দা-বটির কেনাবেচা বাড়লেও নতুন মাত্রা যোগ করে নানা আকারের ছুরি, ধামা, রামদা ইত্যাদি সামগ্রী। সারা বছর বিক্রি না হওয়ায় ছুরি, ধামা, রামদা ইত্যাদি অল্প দাম হলেও বিক্রি করে দিই। তবে ঈদের মৌসুমে বাজারে চাহিদা থাকায় নতুন করে অর্ডার আসে আমাদের কাছে।
এদিকে ঈদকে সামনে রেখে শহরের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমী কামারদের দেখা মিলছে। শহরের বিভিন্ন বন্ধ দোকান এক মাসের জন্য ভাড়া করে অথবা খোলা জায়গায় বসে দা, ছুরি, চাকু তৈরি, শান ও মেরামত করতে ব্যস্ত থাকেন এই সময় কিন্তু ঈদের পরে আর তাদের দেখা মিলে না।
এরকম ভ্রাম্যমাণ কর্মকারদের দেখা মেলে গল্লামারি বাজারেও। সঞ্জয় কর্মকার নামে এক ভ্রাম্যমাণ কর্মকার জানান, আমার মতো অনেকে সারাবছর এই পেশার চাহিদা কম থাকায় বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকলেও ইদের মৌসুমে বাড়তি আয় করতে এভাবে ভ্রাম্যমানভাবে কাজ করে থাকেন। লাভও থাকে ঈদের সময়টাতে।
বয়রা থেকে কোরবানির পশু জবাইয়ের সরঞ্জামে ধার দিতে ও নতুন কিছু সরঞ্জাম কিনতে খালিশপুর কামারপট্টিতে আসা মোহাম্মদ বাহারুল ইসলাম বলেন, কুরবানির পশু জবেহ করা, মাংস কাটা, ও চামড়া ছিলানোর জন্য ধারাল ছুরির প্রয়োজন। ঘরে থাকা দা, বঁটি, ছুরিতে মরিচা থাকায় শানয়ের জন্য নিয়ে এসেছি। সেই সাথে পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য ছোট অথচ ধারালো ছুরি কিনতে এসেছি।
চাহিদা থাকায় পবিত্র ইদুল আজহায় প্রয়োজনীয় এসব সরঞ্জাম কিনতে এসে ক্রেতারা যেনো না ঠকেন সেজন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের বিষয়ে সতর্ক এসব কামাররা। কাজ অনুযায়ীই তারা মজুরি আদায় করেন। সময়ভেদে অর্থ বাড়িয়ে নেন না বলেই জানিয়েছেন তারা।