
জবাবদিহিতা এমন একটি মৌলিক নীতি যা একটি সমাজের সুশাসনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি নাগরিকদের এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নতির জন্য জবাবদিহিতা অপরিহার্য।
জবাবদিহিতার তাৎপর্য
জবাবদিহিতা একটি সমাজে সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এটি কেবল প্রশাসনিক কার্যক্রমকে স্বচ্ছ করে তোলে না, বরং নাগরিকদের আস্থা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জবাবদিহিতা মানে শুধু ক্ষমতাধারীদের তাদের কার্যক্রমের জন্য জবাবদিহিতা বহন করা নয়, বরং এটি একটি সমাজের প্রতিটি স্তরে সঠিক দায়িত্ব পালনের একটি নীতি।
প্রথমত, জবাবদিহিতা রাষ্ট্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। যখন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কর্মকর্তারা তাদের কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহিতা বহন করেন, তখন তারা তাদের দায়িত্ব পালনে আরও মনোযোগী হন। এটি সরকারি সেবার মান বৃদ্ধি করে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করে।
দ্বিতীয়ত, জবাবদিহিতা দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি সুশাসিত সমাজে, যখন সরকারি কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ হয় এবং কর্মকর্তারা তাদের কাজের জন্য জবাবদিহিতা বহন করেন, তখন দুর্নীতি করার প্রবণতা হ্রাস পায়। এর ফলে, জনগণের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া, জবাবদিহিতা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জবাবদিহিতার চ্যালেঞ্জ
যদিও জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অপর্যাপ্ত আইনগত কাঠামো অনেক সময় জবাবদিহিতার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: প্রশাসনিক কার্যক্রমে প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক সময় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ও নিয়মকানুনের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: রাজনীতিকরা অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করে, যা জবাবদিহিতার নীতি লঙ্ঘন করে। এটি প্রশাসনিক কার্যক্রমকে পক্ষপাতমূলক এবং অস্বচ্ছ করে তোলে।
আইনগত কাঠামোর অভাব: জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কঠোর আইন ও নীতিমালার অভাব অনেক সময় কার্যকর জবাবদিহিতার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব: অনেক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে জবাবদিহিতা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব থাকে, যা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাধা সৃষ্টি করে।
উত্তরণের উপায়
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: সরকারি কার্যক্রম এবং অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করতে তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের ব্যবহার করা যেতে পারে।
- নাগরিক অংশগ্রহণ: জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা। জনগণের মতামত এবং সুপারিশ গ্রহণ করে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
- আইনগত কাঠামো: কঠোর আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। দুর্নীতি দমন আইন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইনসমূহ কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা।
- সুশিক্ষা: শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকদের তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা যেতে পারে।
উপসংহার
জবাবদিহিতা একটি সমৃদ্ধ, সুশাসিত ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি। এটি কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে না, বরং সমাজের সকল স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রই পারে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে। অতএব, আমাদের সকলের উচিত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়া এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সুশাসনের মাধ্যমে আমরা কেবল দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারি না, বরং একটি ন্যায়পরায়ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজও গড়ে তুলতে পারি।
আলি আবরার, গণমাধ্যমকর্মী