
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং খেলাফত মজলিসসহ দেশের কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘নির্বাচনের পরিবেশ নেই’ এবং ‘সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন’ হওয়া উচিত। এসব দাবির পেছনে আসলেই কি নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, নাকি নির্বাচন বিলম্বিত করা বা বিএনপির বাইরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠনের কৌশল—সেই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা। সরকার ও বিএনপির মধ্যে এ বিষয়ে এক ধরনের সমঝোতা হয়েছে বলে জানা গেছে। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার পরপরই জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামী দল অসন্তোষ প্রকাশ করে।
জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলের নেতারা মনে করছেন, বর্তমানে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ নেই। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখন বিএনপির ঘনিষ্ঠদের হাতে, যা ভোটগ্রহণকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে না—এটি শুধু আমাদের কথা নয়, এটি দেশের সাধারণ মানুষের কথা।
নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে, জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে ‘ইসলামপন্থী ভোট’ ভাগ না হয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সরকারপ্রধানের বৈঠকের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা তৈরি হয়েছে, বিএনপি ইতোমধ্যে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে গেছে। তার ভাষায়— লন্ডন বৈঠকের পর থেকেই মনে হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায়, তাহলে নির্বাচনের পরিবেশ কেমন হবে?
একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবে কীভাবে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ চায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে কাজ করুক।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দাবি, নির্বাচন যদি সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তা জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলনে সহায়ক হবে। তাদের মতে, প্রচলিত ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোর অবস্থান গুরুত্ব পায় না।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর মনে করেন, জামায়াত পিআর পদ্ধতি নিয়ে কতটা আন্তরিক, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও তিনি স্বীকার করেন, দেশে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তির কর্তৃত্বমূলক অবস্থান রয়েছে, ফলে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে বাস্তব উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
দলগুলোর চাওয়া কী?
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এরপর, জামায়াত ইসলামী ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করে। বিশেষত ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দলকে তাদের পাশে টানার চেষ্টা চালায়। মূলত, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে ‘সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে’—এই প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। আর সেই থেকেই সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।
এদিকে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার চেষ্টাও চলছে। অনেক ধর্মভিত্তিক দল এখনও বিএনপির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখলেও, কিছু দল এখন নিজেদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে, যেন তারা আগামী নির্বাচনে একসাথে অংশ নিতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সাফ বলেছেন, তাদের মূল লক্ষ্য ‘ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভোট এক জায়গায় রাখা’ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে সংশোধন আনা।
অবশ্য, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিভিন্ন দাবির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৮ জুন এক বক্তব্যে বলেন, যাদের আর নির্বাচনে গুরুত্ব থাকবে না, তারাই এখন নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে।
জামায়াত পিআর পদ্ধতি নিয়ে কতটা আন্তরিক, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও দেশে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তির কর্তৃত্বমূলক অবস্থান রয়েছে, ফলে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে বাস্তব উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর
এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, এই পদ্ধতি বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটা উপযোগী, তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ইসলামী দলগুলোর নেতারা বলছেন, তারা কোনোভাবেই নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান না; বরং একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, যেন-তেন নির্বাচন হয়ে লাভ কী? এখন থানায় শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে —এমন ঘটনাও ঘটছে, অহরহ। এরকম পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব?
খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদও একই সুরে বলেন, সংস্কার ও বিচার ব্যবস্থা দৃশ্যমান হওয়ার পরেই নির্বাচন হওয়া উচিত। এখন নির্বাচনের পরিবেশ নেই।
বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই অবস্থায় ইসলামী দলগুলোর নেতারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করছেন এবং নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী জোট গঠনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। সেই প্রক্রিয়া কিছুটা দৃশ্যমান হয়, ২৮ জুন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে, যেখানে জামায়াতের নেতারাও যোগ দেন।
ওই সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত থাকলেও, দেখা যায়নি বিএনপির কাউকে। সমাবেশে ইসলামী দলগুলো পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানায় এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্য গঠনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কথা বলেন।
জামায়াতে ইসলামী ১৯ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে, যেখানে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হবে। জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, ধর্মভিত্তিক সবাইকে একসাথে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য কাজ করছে জামায়াত। একই সঙ্গে, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবে কীভাবে?
নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা?
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসলামী দলগুলোর এমন তৎপরতা মূলত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হতে পারে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হয়।
তাদের মধ্যে একজন দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তিনি মনে করেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে, তিনি বলেন, জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে ‘ইসলামপন্থী ভোট’ ভাগ না হয়।
তবে, জামায়াত ও অন্য ইসলামী দলগুলোর দাবির মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে চাপ তৈরি এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল রয়েছে, যাতে তারা নিশ্চিত করতে পারে যে সত্যিকার অর্থে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয় বলে মনে করেন প্রথিতযশা এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সূত্র: বিবিসি