
দেশীয়দের ব্যবসা আসলে বন্ধ করা হচ্ছে না। দেশীয়দের নাম করে একদল স্বৈরাচারের দোসর, মাফিয়া ব্যবসায়ী, যারা এত বছর ধরে সিন্ডিকেট তৈরি করছিল, যারা এই সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় না, যারা এই সিন্ডিকেট ভেঙে নতুনদেরকে এই টেলিকম ব্যবসায় আসতে দিতে চায় না তারাই অপব্যাখ্যা বা অপতথ্য দিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
তিনি বলেন, আমরা নতুন প্রজেক্ট না এনে নতুন পলিসি তৈরিসহ অনেকগুলো কাজ করছি। সেজন্য যারা এতদিন দুর্নীতি করেছে তাদের স্বার্থে এখন আঘাত হানছে। যে কোম্পানিগুলো স্বৈরাচারের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়েছে, যাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে শত শত কোটি টাকার দেনা, ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণখেলাপি, তারা আমাদের বিরুদ্ধে অর্থ ব্যয় করে অপপ্রচারে লিপ্ত বলে আমি সন্দেহ করি।
সোমবার (৭ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, যদি একটা দেশে ৪০ শতাংশের বেশি বা তার আশপাশের হারে ইন্টারনেট প্রবৃদ্ধি না হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশের ডিজিটাল ইনফ্রাকচারে সমস্যা আছে। আমরা এজন্য বলছি বিটিসিএল ফাইবার নেটওয়ার্ক বর্ধিত করণের যে প্রজেক্টটা বিগত সরকারের আমলে নিয়েছে, যার টেন্ডার বিগত সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে এবং সেই টেন্ডারের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিতও বিগত সরকারের আমলে করা হয়েছে। সেসময় একটা এলসিও করা হয়েছিল। আমি এবং নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার আগে সেই এলসিতে ২৯০ কোটি টাকা অফেরতযোগ্য হিসেবে পরিশোধও করা হয়ে গেছে।
‘এই সবকিছু আমলে নিয়ে আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি নিজে ওনার অফিসে গিয়েছি। আমি সাক্ষাতে বলেছি যেহেতু ২৯০ কোটি টাকা চলে গেছে, যেহেতু এটা সর্বনিম্ন দরদাতা, ক্যাপাসিটি নিয়ে যে অপতথ্যটা এসেছিল সেটা যেহেতু বুয়েট ক্ল্যারিফাই করেছে, আমরা একটা কমিটি করে দেব, সেই কমিটির মাধ্যমে যে ইকুইপমেন্টগুলো (এম১২স এবং এম২৪) তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিটিসিএলের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ব্যাপক হারে স্থাপন করেছে।’
তিনি বলেন, কিছু বিশেষ কোম্পানি এই মার্কেট থেকে বিটিসিএলকে আউট করতে চায়। এই বক্তব্য তুলে ধরার পর দুদক চেয়ারম্যান জানান, ঠিক আছে, আপনাদের বক্তব্যগুলো লিখে জানান। সেই রেফারেন্সে আমরা লিখিত আকারে চিঠি লিখে মূলত আমাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছি।
যুক্তির বিষয়গুলো তুলে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, যেহেতু টাকাটা চলে গেছে (২৯০ কোটি টাকা) যেহেতু বিটিসিএলের ক্যাপাসিটি বাড়ানো দরকার। বর্তমানে যে ক্যাপাসিটি আছে তা জেলা পর্যায়ে মাত্র এক জিপিপিএস। এটা দিয়ে আসলে বেটার কোয়ালিটির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া অসম্ভব। এই মুহূর্তে বিটিসিএল যদি এই নেটওয়ার্ক সেবাটা আপডেট না করে তাহলে খুব দ্রুত বিটিসিএল মার্কেট আউট হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, যেহেতু বিটিসিএলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান তাদের নেটওয়ার্ক আপডেট করেছে, অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে তৈরি করা বিভিন্ন ঝামেলার কারণে, দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন কারণে কাজটা বন্ধ রয়েছে বলেই বিটিসিএলের ফাইবার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না।
‘উপরন্তু বিটিসিএলের মোট প্রজেক্টের মধ্যে দুটো বিষয়। একটা হচ্ছে আইপি নেটওয়ার্ক, আরেকটা হচ্ছে ফাইবার ডিডব্লিউডিএম নেটওয়ার্ক। আইপি নেটওয়ার্কের কাজ ইতোমধ্যে ৭০/৮০ শতাংশ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই ৩০০ কোটি টাকা আজ কোনো কাজে আসছে না। কারণ সেই নেটওয়ার্কের জন্য যে সার্ভার বসানো হয়েছে তা সংযোগ করার জন্য ফাইবার ডিডব্লিউডিএম নেটওয়ার্কটা দরকার। সেজন্য আমরা যুক্তি উপস্থাপন করেছি যে, যেহেতু টাকা চলে গেছে সুতরাং আমাদের কাজটা করতে দেওয়া হোক। আর যেহেতু বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত এসব ইকুইপমেন্ট। আমরা একটা কমিটি করে দেব, সেই কমিটি নিশ্চিত করবে যে সেসব সঠিক ইকুইপমেন্ট কি না।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, এটাকে ভিন্নভাবে অপব্যাখ্যা করে আমার ও আমার মন্ত্রণালয়, সরকারের চরিত্র হননের একটা চেষ্টা মিডিয়াতে হয়েছে, যেটা আপনারা দেখেছেন। আমি এর নিন্দা জানাই। আমি ও আমার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা কোনোভাবে কোনো দুর্নীতিতে জড়িত নই। এখানে যত ধরনের কাজ হয়েছে প্রত্যেকটা কাজ আগের সরকারের আমলে করা হয়েছে। আমরা শুধু কিছু চিঠি আদান-প্রদান করে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। আমরা দুদকের আন্তরিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছি। এর বাইরে আমরা কোনো নির্দেশ দিইনি। উল্লেখ্য, এই প্রজেক্টের বিপরীতে দুদকের পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো ধরনের কোনো মামলা নেই।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমরা বলেছি যদি এই কাজটা করা না হয়, এলসি করা না হয় তাহলে মোট ৬০০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে। একইসঙ্গে বিটিসিএলের তার ডিডব্লিউডিএম বাজারে দুর্বল হয়ে মার্কেট আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবমিলিয়ে আমরা বলতে চাই, আইসিটিতে আমরা আড়াই হাজার কোটি টাকার অন্যায্য প্রকল্প বাদ দিয়েছি। নতুন বাজেটে আমরা আইসিটি থেকে নতুন প্রকল্প তুলিনি। এজন্যই তুলি নাই যে, একনেক মিটিংয়ে, এনইসি মিটিংয়ে আমি প্রধান উপদেষ্টা স্যারকে বলেছি, এখানে অনেক দুর্নীতি হয়েছে, ২০টার মতো প্রজেক্ট এখানে আছে। ৬টার মতো পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমে আছে। আমি চাই এই প্রজেক্টগুলোকে অপটিমাইজড করতে। অর্থাৎ এখানে একটা শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে। এটা যখন শেষ হবে তখন আমরা নতুন প্রজেক্ট তুলব।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদ্যমান যে স্পেসিফিকেশন আছে তাতে ভুল পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেমন ধরেন, ডেটা সেন্টার আছে কিন্তু সেখানে কোনো সাইবার সিকিউরিটির কোনো এলিমেন্ট নাই, মনিটরিং এলিমেন্ট নাই। এনভাইরনমেন্ট কন্ট্রোল করার মতো কোনো এলিমেন্ট নাই। আমরা এমন কোনো টেন্ডার দিইনি যেখানে যে কোম্পানিটি ফাইনান্সিয়াল বা টেকিনিক্যাল ইভালুয়েশনে নাম্বার-১ হয়নি। আমরা সর্বত্র কমপ্লায়েন্স আনার চেষ্টা করছি। যেহেতু আমরা এই কাজগুলো করছি সেজন্য যারা এতদিন দুর্নীতি করেছে, তাদের স্বার্থে আঘাত হানছে। যে কোম্পানিগুলো স্বৈরাচারের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়েছে, যাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে শত শত কোটি টাকার দেনা, ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণখেলাপি, তারা আমাদের বিরুদ্ধে অর্থ ব্যয় করে অপপ্রচারে লিপ্ত বলে আমি সন্দেহ করি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, আমি গণমাধ্যমের কর্মীদের অনুরোধ করব, সরকারের যে উদ্যোগগুলো আছে সেই উদ্যোগগুলোর বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রতিবেদন দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। শুধু তাই নয়, আমি উল্লেখ করতে চাই। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় আমরা দুটো শ্বেতপত্র প্রস্তুত করছি। আইসিটিতে আমরা আইসিটি শ্বেতপত্র আর ডাক ও টেলিকমে আমরা দুটো আলাদা শ্বেতপত্র করছি। একটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোনাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নেয়াজ আসাদুল্লাহ, আরেকটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান। আপনাদের যাবতীয় ফাইন্ডিংস তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। তারা দুটো আলাদা মন্ত্রণালয়ের সামনে পোস্ট বক্স রেখেছেন, ই-মেইল দিয়েছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তথ্য চেয়েছেন। যে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ করতে পারবেন।
ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেন, আমাদের মোরাল স্ট্রেংথ এত বেশি যে আমরা মনে করি এসব কাজ আমরা শেষ করে যেতে পারব। দেশের মানুষের জন্য যা ভালো আমরা তাই করছি।
নতুন পলিসি করা হচ্ছে। এই নতুন পলিসি কার্যকর হলে দেশীয় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারাবেন। জায়গা পাবেন বিদেশিরা– এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, এটা সম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা। যখন তাদের লাইসেন্স লিমিট শেষ হয়ে যাবে তখন কারো লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হবে না। প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট সময় ১০ বা ১৫ বছর মেয়াদে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তার লাইসেন্সের মেয়াদ চলাকালে কোনো ধরনের প্রভাবিতও করা হবে না। তবে যেটা করা হবে সেটা হচ্ছে– যেহেতু এসব লাইসেন্স আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি নেই, নতুন লাইসেন্স ব্যবস্থায় আমরা এসব লাইসেন্সগুলো কন্টিনিউ করব না। তখন তাদের নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন লাইসেন্স কিনে নতুনভাবে ব্যবসা করতে হবে। আমরা সেজন্য বলেছি, যারা নতুনভাবে আবেদন করবেন তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এটা নতুন পলিসিতে স্পষ্ট করে বলা আছে। এর বাইরে আইসিএক্স, আইজিডব্লিউগুলো যাদের আছে, যাদের মেয়াদ ২০২৭ সালের দিকে শেষ হবে, তারা চাইলে আউটসোর্সিং হিসেবে এক্সজিস্টিং লাইসেন্সের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে। সুতরাং এটা অপব্যাখ্যা। দেশীয়দের ব্যবসা আসলে বন্ধ করা হচ্ছে না। বরং দেশীয়দের নাম করে একদল স্বৈরাচারের দোসর, মাফিয়া ব্যবসায়ী, যারা সিন্ডিকেট তৈরি করছিল, যারা এই সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় না, যারা এই সিন্ডিকেট ভেঙে নতুনদের এই টেলিকম ব্যবসায় আসতে দিতে চায় না তারাই অপব্যাখ্যা বা অপতথ্য দিচ্ছেন।