
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে দেশের অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে এলসি খোলার হার। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না দেশের আমদানিকারকরা। এতে দেশে ভোগ্যপণ্য সংকটের পাশাপাশি দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। ২-৩ লাখ ডলারের এলসি খুলতেও চাচ্ছেন না ব্যাংক কর্মকর্তারা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। সূত্রগুলো জানায়, ডলার সংকটের কারণে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করে সরকার। এরপর থেকে আমদানির পাশাপাশি এলসি খোলার হার হ্রাস পেতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে গত ৪ঠা জুলাই আমদানি ঋণপত্র খোলার ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয় শতভাগ।
আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এদিকে আমদানি কমতে থাকায় রপ্তানি কমে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
১৩ মাস পর গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় ৬.২৫ শতাংশ কমতে দেখা গেছে। ওদিকে রেমিট্যান্সও কমছে। সার্বিকভাবে লেনদেনে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ধারাবাহিকভাবে কমছে এলসি: চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ কমতে শুরু করে। গত জুন মাসে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৮৪৪ কোটি ডলার, জুলাইতে তা ৬৩৫ কোটি ডলারে নামে। আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৬৩৩ কোটি ডলারে। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে আরও কমে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটি ডলারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা ব্যাপকভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৬০ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫.৭৪ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১৭৭ কোটি ডলারের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছিল। এদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার হার কমেছে ১৪.৫৭ শতাংশ।
এছাড়া মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪.৫৬ শতাংশ। এই ৩ ধরনের পণ্যকে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই এসব পণ্যের আমদানি কমাকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য বাধা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক নানামুখী চাপের মধ্যে কেউ নতুন উৎপাদনে যাচ্ছেন না। আর এজন্যই মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, আগস্টে এলসি খোলা হয়েছে ৬৩৩ কোটি ২৯ লাখ ডলারের। পরের মাসে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে এটি আরও কমে দাঁড়ায় ৫৭০ কোটি ২৪ লাখ ডলারে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এলসি খোলার হার। অন্যদিকে জুলাই মাসে দেশে মোট আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলার পণ্যের, যা জুন মাসের তুলনায় ৩১.৩২ শতাংশ কম। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে ৫০.৯৯ শতাংশ। ভোগ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে ৪.৫৬ শতাংশ।
এদিকে দেশে আমদানি কমলেও ডলার সংকট সহসাই কাটছে না। এ অবস্থায় বাজারে সংকট কাটাতে ডলার বিক্রিও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে ৩৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এভাবে ডলার বিক্রির ফলে রিজার্ভেও চাপ বেড়েছে। রাজধানীর ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা জানান, দেশে ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল, গম, আদা, রসুন, পিয়াজসহ মসলা জাতীয় অন্যান্য পণ্য আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। অথচ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দোহাই দিয়ে এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রেখেছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং পণ্যের সংকট তৈরি হবে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ জোগানোর চাপ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এলসি খোলার হারও কমে গেছে। এ ছাড়া রপ্তানি আয় আসার একদিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। ৩০ লাখ ডলারের বেশি আমদানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২৪ ঘণ্টা আগে জানাতে বলা হয়েছে।
রাজধানীর বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ স্বপন জানান, চাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। আগামী মাসের শুরুতে এলসি খোলার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়েছে। আরেক ব্যবসায়ী মানিক বলেন, চীন থেকে ২৯ টন রসুন আমদানির জন্য গত সপ্তাহে দুটি এলসি খোলার চেষ্টা করি। এরমধ্যে এক সপ্তাহ ঘুরে একটি এলসি খুলতে পেরেছেন। ইউসিবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক এলসি খুলতে অপারগতা জানিয়েছে। দেশের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমদানির এলসি খোলার তথ্য বলছে, প্রায় সব ব্যাংকই সাধারণ গ্রাহকদের আমদানির এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খুলতেও ব্যাংকগুলো অপারগতা প্রকাশ করছে। সম্প্রতি এলসি খোলায় জটিলতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা এলসি খোলার জটিলতা নিরসনের আশ্বাস চেয়েছেন। একইসঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দ্রুত কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ বলেন, জরুরি নিত্যপণ্য আমদানির এলসি খোলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই।
বিবেচনা সাপেক্ষে এলসি খোলা বহাল আছে। তবে ডলার রেটের তারতম্যের কারণে পরিমাণটা অনেক কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আমদানির ওপর শর্ত আরোপ করে তখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। কারণ অনেক অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশ অনেকাংশে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। তাই শিল্প যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। সালেহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও গভীরভাবে দেখা উচিত যে পণ্যগুলো ঠিকভাবে আসছে কিনা। কোনো কাজে মেশিন আনা হচ্ছে নাকি মেশিন আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিং করে টাকা পাচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট আমদানি বাড়াতে হবে। অন্যথায় মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুুবুর রহমান বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কমানো হয়েছে। আমাদের ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ৭০ শতাংশই রেমিট্যান্স থেকে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছে। এ কারণে আমদানির এলসি খুলতে বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন এলসি খোলা কমিয়ে এনেছি।
পিএসএন/এমঅাই