
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক জোরদারের পদক্ষেপ যেন নতুন এক কূটনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত এক বছরে তিন দফা চীন সফর করেছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। শেষবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল চীন সফর করে দেশে ফিরেছে মাত্র কয়েকদিন আগে।
ফিরেই বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে।
সফরে তারা চীনের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সান ওয়েইডং, কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও এবং ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের ভাইস চেয়ারম্যান লি হংঝংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ভাষ্য, আমরা বলেছি, সরকার গঠন করলে যেন তাদের (চীনের) কোনো সমস্যা না হয়, ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে। তারা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। আমরাও তাই দেখেছি।
এই সময়টা চীনের জন্য একটি ‘অপর্চুনিটি উইন্ডো’। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন কিছুটা বৈরিতার জায়গায়। তাই চীন কৌশলগতভাবে চাচ্ছে—এই ফাঁকটুকু কাজে লাগাতে।
ড. সাহাবুল হক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ-চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি
তিনি আরও জানান, চীনের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ যে বৈঠক হয়েছে, তা সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গেই হয়—এতে স্পষ্ট চীন বিএনপিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর রাজনৈতিক কূটনীতির অংশ হলেও, এর অন্তরালে রয়েছে বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব। কারণ শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর জামায়াত ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও চীন সফরে গিয়েছেন।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ মনে করেন, চীন বুঝতে চাইছে— বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর তাদের স্বার্থ কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে। তিনি বলেন, চীন বিএনপিকে জানিয়েছে—তারা কী চায়। আর বিএনপিকেও বুঝিয়েছে—এই অঞ্চলে চীনের আগ্রহ কী।
২০২৪ সালের নভেম্বর, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি এবং সর্বশেষ জুন—এই তিন সময়ে বিএনপির তিনটি প্রতিনিধিদল বেইজিং সফর করেছে। প্রথমটি ছিল আসাদুজ্জামান খান রিপনের নেতৃত্বে, এরপর আবদুল মঈন খান, আর সর্বশেষ মির্জা ফখরুল।
অর্থনীতির অঙ্কটাই কি বড়?
বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প, রফতানি, বন্দর উন্নয়ন, টেলিকম খাতসহ বিভিন্ন খাতে রয়েছে চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ-চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ড. সাহাবুল হক মনে করেন, এই সফরগুলো কূটনীতির বাইরের অর্থনৈতিক কূটনৈতিক (economic diplomacy) হিসাবও বহন করে। চীন নিশ্চিত হতে চায়—পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের স্বার্থ রক্ষিত থাকবে।
বিএনপির তরফ থেকেও চীনের কাছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গয়েশ্বর রায়। তার ভাষায়, আমরা তাদের বলেছি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তাই আমরা তাদের আর্থিক সহায়তা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছি।
সম্প্রতি চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। এতে ‘সম্ভাব্য আঞ্চলিক জোট’ গঠনের ইঙ্গিত মিলেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়, বরং ভারতের প্রতিও একটি বার্তা। আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সেই সম্পর্ক কিছুটা শীতল হওয়ায় চীন এখন কৌশলগতভাবে সক্রিয় হয়েছে।
অধ্যাপক সাহাবুল হক বলেন, এই সময়টা চীনের জন্য একটি ‘অপর্চুনিটি উইন্ডো’। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন কিছুটা বৈরিতার জায়গায়। তাই চীন কৌশলগতভাবে চাচ্ছে—এই ফাঁকটুকু কাজে লাগাতে।
তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ এই বিশ্লেষণ পুরোপুরি মানেন না। তার মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা প্রশ্নে ভারত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়া গেলেও, তা ভারতের বিকল্প হতে পারে না।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে হবে। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতের প্রভাব সরাসরি।
বিএনপি কি প্রস্তুতি নিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য?
বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে—এই সফরগুলো কৌশলগত বন্ধুত্ব গড়ার অংশ। চীনের সঙ্গে পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক জোরদার করে, তারা ভবিষ্যতের সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও একটি নিরব সহমত তৈরি করতে চাইছে।
দলটি মনে করে, সরকার পরিবর্তনের পর চীন যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে। বরং বর্তমান সম্পর্কের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে আরও টেকসই করতে চায় তারা। সূত্র: বিবিসি