বিএনপি সংস্কার চায়নি, সংস্কারের পর্যায়ে গণভোটও চায়নি বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।
জাতীয় নির্বাচন আর গণভোট কেন তারা একসঙ্গে চায়? এমন প্রশ্ন তুলে তাহের বলেন, তারা (বিএনপি) গণভোটটাকে গলা টিপে হত্যা করতে চায়। কারণ শুরু থেকে তারা তো গণভোট চায়নি। এখন বাধ্য হয়ে গণভোট নিয়েছে। আবার প্যাঁচ লাগিয়ে এটারে কেমনে মাইনাস করে দিতে চায় সে রাস্তায় গেছে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির দেওয়া নোট অব ডিসেন্টগুলো যদি সন্নিবেশিত হয় তাহলে তো এসব সংস্কারের প্রয়োজন নাই, এখন এসব ছুড়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিলেই তো হয়। তালবাহানা করার তো কোনো দরকার নাই, আপনি বলে দেন আমি কিছুই মানি না। যদিও আজকে তারা কিছুটা বলছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনের চতুর্থ তলায় আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলন একথা বলেন তিনি।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বিএনপি প্রথমে কোনো সংস্কারই চাচ্ছিল না। এরপরে জনগণের চাপে তারা সংস্কার কমিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বিএনপিকে একমোডেট করার জন্য আমরা অনেক স্যাক্রিফাইস করেছি। অনেক পয়েন্টে মাইনাস করছি। পিএসসি থেকে শুরু করে অনেকগুলোর জন্য একটা সাংবিধানিক বডি করে দেওয়া, যেখানে প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট-সরকারি দল যেমন : চাকরি নিয়োগের ক্ষেত্রে, তারপর ইলেকশন কমিশনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এটা বিএনপি বিরোধিতা করেছে, কেন করেছে আল্লাহই ভালো জানে এটাতো ভালো জিনিস, নিরপেক্ষ থাকতে পারে তবুও তারা করেছে। করার পরে আমরা আলোচনার সুবিধার জন্য এবং আলোচনা কন্টিনিউ করার জন্য স্যাক্রিফাইস করেছি।
তিনি বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে ১০ বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। তখন পত্রিকা দেখলাম যে বিএনপি মেনে নিয়েছে। কিন্তু আবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। দিছেন তো দিয়েছেন, তাতে তো কোনো অসুবিধা নাই, রেজাল্ট যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আরেকটা ছিল দলীয় প্রধান আর প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে হতে পারবেন না। এটা তো বিএনপির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত না। এটা যদি জামায়াতে ইসলামীও ক্ষমতায় আসে তাহলে আমাদের আমির শফিক সাহেব আমির আর দলীয় প্রধান একসঙ্গে হতে পারবেন না। বাকিদেরও একই।
তিনি বলেন, আমরা আর ফ্যাসিবাদ চাচ্ছি না। আমরা চাচ্ছি ক্ষমতার ডিস্ট্রিবিউশন। যেমন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে বিএনপির অনেক আপত্তি ছিল, আমরা সেখানেও কিছু পয়েন্টে স্যাক্রিফাইস করেছি। একজন দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।
তাহের বলেন, এটা বিএনপি কেন মনে করে যে তারাই ১০০ বছর আগামীতে ক্ষমতায় থাকবে? তাদের জন্য এই আইনটা হলে সমস্যা হবে? এটা তো জনগণের ভোটাধিকারের যে একটা ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতাকে অস্বীকার করা।
‘আমরা’ চিন্তা করে যদি সংস্কার হয় তাহলে তো আর দেশের সংস্কার হলো না। বিএনপির আচরণ হচ্ছে তারা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা কোথায় লাভবান হচ্ছে তাদের জন্য কী উপযোগী, সেই হিসাবে উনারা একটা সংস্কার চাচ্ছেন। এখন একটা দলের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের বিষয়ে সংস্কার করলে এটা তো আরও খারাপ সংস্কার হয়ে যায়। দেশ আরও রসাতলে যাবে।
আমরা খুব স্পষ্ট বক্তব্য দিতে চাই, ঐকমত্য কমিশন পরিশ্রম করে, রাজনৈতিক দলগুলো পরিশ্রম করে দেশের কল্যাণে আমরা সবাই ছাড় দিয়ে যে ঐকমত্য কমিশনের কন্সেনসাস হয়েছে, রিফর্মসের ব্যাপারে। যেটা জুলাই চার্টার হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। সেটা আমরা বাস্তবায়ন চাই পরিপূর্ণ। এখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে জনগণ সেটাকে গ্রহণ করবে না।
তিনি বিএনপিকে উগ্রবাদী আচরণ বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই পর্যায়ে এক্সট্রিমিজম বাদ দিতে হবে। বিএনপির সংবাদ সম্মেলনের ড্রাফট পেয়েছি। একটা জায়গায় উনারা লিখছেন যে আমরা কোনোভাবেই মানবো না। এখন তার বিপরীত লোকেরা যদি বলে যে, বিপরীত কিছু হলে আমরা কোনোভাবেই মানবো না। তাহলে কি দাঁড়াবে? কোনোভাবেই মানবো না, মানে, কোনোভাবেই মানবো না। পরিস্থিতিটা এদিকে চলে যাওয়াটা কি দেশের জন্য কল্যাণ হবে? এটা দেশের জন্য কল্যাণ হবে না বলে আমি মনে করি। সুতরাং সবাইকেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা একটা পরিবেশ তৈরি করা উচিত এবং ফেব্রুয়ারিতে আমাদের চার্টার গ্রহণ করার পরে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে আমরা যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারি সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সেক্ষেত্রে আমি সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করছি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনতিবিলম্বে আদেশ জারি করে গণভোটের তারিখ ঘোষণা এবং ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাই।
তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশন একটা আরপিও ফাইনাল করেছে এবং সে আরপিওটি মন্ত্রিপরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদ যেটাই বলেন সেখানেও গৃহীত হয়েছে। মানে সরকারও গ্রহণ করেছে, ইলেকশন কমিশন গ্রহণ করেছে। বিএনপি কিন্তু তখন আগে কোনো আপত্তি দেয় নাই। বরং এর আগে তারা যখন বলেছিল তারা পজিটিভ। প্রত্যেকটি দল তার নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। এটা জোটভিত্তিক হোক বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট দলভিত্তিক হোক এবং এটার ভেতরে অনেক যুক্তি আছে। সেটা হচ্ছে প্রত্যেকটি দল করে নিজের একটা আদর্শ ভিত্তিতে। সে মার্কা নেয় নিজের একটা পরিচয়ের ভিত্তিতে আইডেন্টিটির ভিত্তিতে। একটি জাতীয় নির্বাচনে তো তার আদর্শ এবং তার আইডেন্টিটি টাই মানুষের কাছে যাবে। তাহলে তো তার দলকে মানুষ গ্রহণ করে কি করে না এটা প্রমাণিত হবে।
তিনি বলেন, আপনি জোটে যেতে পারেন, জোট আপনাকে সাহায্য করবে যে আপনি কি এটা জনগণ জানুক। তারপরে আপনার বন্ধু জোট আপনাকে ভোট দেবে, সাহায্য করবে। ইটস ন্যাচারাল। এটাই হতে হবে।
এখন কোনো একটি দল তার নিজস্ব অস্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে, তার প্রতীক বিকিয়ে দিয়ে, তার নাম বিকিয়ে দিয়ে আরেকটা দলের আশ্রয়ে যদি নির্বাচন করে তাহলে তো ওই দলে নির্বাচন হয় না। যে দলের মার্কা সেই দলের নির্বাচন হয়ে যায়। সেই দলের জন্য ৩০০ আসনে নির্বাচন করার সুযোগ আছে। সুতরাং আমরা এটা মনে করি আমরা জোটবদ্ধভাবে করি বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং করি। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেকটি দল এখানে আলাদা অস্তিত্ব বহন করে। সুতরাং সেই দলের নাম এবং প্রতীকে নির্বাচন হবে। বাকিরা তাকে সাহায্য করবে। যারা ভোট দিতে চায়, সাহায্য করতে চায় করবে। এতে কোনো আপত্তি নাই। এটা রেশনাল। কিন্তু বিএনপি এখানে এসে পরে বলতেছে যে এটাও আমরা মানি না।
তাহের বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যদি কিছুই না মানেন ওটা তো একটা সমস্যা। আমরা আশা করবো প্রতীকের বিষয়ে কোনো দল চাপ দিয়ে ইলেকশন কমিশনকে যেন বিতর্কিত না করেন। কারণ ইলেকশন কমিশন যদি এখন বিএনপির কথা এটা চেঞ্জ করে দেয় আইন, তাহলে তো এটা পরিষ্কার হবে যে ইলেকশন কমিশন একটি দলের পক্ষে ভূমিকা দিচ্ছে। তাহলে ইলেকশন কমিশন আবার বিতর্কিত হবে।
সরকার যদি আবার মন্ত্রিপরিষদে বসে বিএনপির কথায় চেঞ্জ করে তাহলে বুঝা যাবে যে সরকার বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। তাহলে সরকারেরও সমস্যা। আমরা যে বলছি একটা অবাধ নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক, হাসিখুশিতে ভরা একটি নির্বাচন হবে এবং এই সরকার ইলেকশন কমিশন নিরপেক্ষ, সরকার নিরপেক্ষ। তাহলে এ কথার তো যথা (দাম) থাকছে না।
৫৪ বছর বাংলাদেশ সঠিক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত উল্লেখ করে তাহের বলেন, বিগত ১৫ বছর এরকম একটি অর্থহীন নির্বাচনের আজকের স্বৈরশাসন, আজকের ফ্যাসিবাদ। সেটাকে তো দৌড়িয়েছি আমরা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে। কিন্তু আবার সেই নির্বাচন, আবার সেই ষড়যন্ত্র। আবার সেই ইলেকশন কমিশনের নির্বাচন ঘোষণা দেওয়ার, সেসব বাংলাদেশ আর এক্সসেপ্ট করবে না। এটা আমরা পরিষ্কার বলছি।
সব শ্রেণির পেশা মানুষ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারস সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাহের বলেন, বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য আসুন আমরা সবাই কাজ করি, যে যার জায়গা থেকে এবং কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র এবং অপচেষ্টাকে আমরা রুখে দেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশন কিছু কাজ না করলেও হতো। যেমন ইলেকশন কমিশন একটা প্রস্তাব করলে ভালো হতো। গণভোটের সাবজেক্ট ডিফারেন্ট।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ নির্বাচন কমিশন বা কোনো দল বা সরকারের সম্পদ না, পুরো জাতির সম্পদ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তাহের বলেন, বিশেষজ্ঞরা রাত দিন এরকম বহু মিটিং করেছি। আমরা আমাদের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞরা কমিশনের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসেছে। সব বিশেষ একসঙ্গে বসছে। তারা সবাই বসেই এই আদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি যেটা বলছি এখন এটাই বিশেষজ্ঞদের মত এবং এটাই তারা সাবমিট করেছে।
দুই নম্বর কথা হচ্ছে- আমরা এগুলো আদায় করতে পারি, এটা পারবো কিনা? নির্বাচন কি হয়েছে? আমরা কি করতে পারবো না পারবো ওয়েট আপ ইলেকশন। আমাদের আন্দোলন চলছে। আজকেও তো আটটা মিছিল গেছে ইলেকশন কমিশনে।
বিএনপি সংস্কার চায়নি, সংস্কারের পর্যায়ে বিএনপি গণভোট চায়নি উল্লেখ করে তাহের বলেন, গণভোট কেন তারা একসঙ্গে চায়! তারা গণভোটকে গলা টিপে হত্যা করতে চায়। কারণ শুরু থেকে তারা তো গণভোট চায়নি। এখন বাধ্য হয়ে গণভোট নিছে। আবার প্যাঁচ লাগিয়ে এটাকে কীভাবে মাইনাস করে দিতে চায় সে রাস্তায় গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় এ নেতা বলেন, আপনি দেখেন একইদিন যদি গণভোট হয়, গণভোটে কোনো ভোট পড়বে না। কেন? আমি সিরিয়াস থাকবো ধানের শীষ নিয়ে, আমার এখন গণভোট মনে থাকবে। আমার তো ধানের শীষে একটা ভোট বাড়ালে আমার জন্য সেখানে ভালো। বিএনপি ধানের শীষের জন্য। আমি পাল্লার জন্য আরেকজন আরেকজন জান বের হয়ে যায় ইলেকশনের দিন। ভোটের দিন মানুষের হুঁশ থাকে নাকি? সুতরাং সেদিন গণভোট যে একটা হবে এটা আর মাথায় থাকবে না।
কায়দাকানুন করে একটা বস্তার উপরে আরেকটা বস্তা চাপা দিয়া ওটা রে মেরে ফেলার একটা চেষ্টা করা। যদিও বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট বলছে, এগুলো যদি সন্নিবেশিত হয়, পাস না হয় তাহলে তো সংস্কারের প্রয়োজন নাই, এখন এসব ছুড়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিলেই তো হয়। তালবাহানা করার তো কোনো দরকার নাই, আপনি বলে দেন আমি কিছুই মানি না। যদিও আজকে তারা কিছুটা বলছে।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, ড. এইচএম হামিদুর রহমান আজাদ, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ।
