
২০২৪ এ এসে মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব ও ইন্টারনেট আমাদের জীবন প্রবাহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আমাদের চিন্তাধারা, যাপিত জীবন কাঠামো ও আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের নানান কাজ বহুলাংশে সহজ করে দিয়েছে। মানুষের জীবন ইতিহাসের পাতায় কবে এতোটা সহজ হয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না।
কিন্তু সকল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আছে, প্রযুক্তিও এর বাইরে না। বর্তমানে আমরা আমাদের কাজ ব্যতীত অবসরেও প্রযুক্তিতে ডুবে রই, এটিও কি প্রযুক্তির কল্যাণ না সর্বনাশ? নিজের ছোট ছেলেমেয়েদের একটু কান্নাকাটিতে কিংবা ওদের চাওয়ার জন্য হাতে মোবাইল, ট্যাব কিংবা স্মার্ট টিভির সামনে বসিয়ে দেই। একাজগুলি ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু কল্যাণকর ?
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, বছর দশেক পেছনের কথা। একটি অবুঝ শিশুর কোমরে ঘুংঘুর কালো রশি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হতো, অথবা পায়ে বাঁশিযুক্ত জুতা পড়ানো হতো, যত দূর বাঁশির শব্দ কিংবা ঘুংঘুরের শব্দ যেত, তত দূর ছিল শিশুর চলাফেরা ও দুষ্টমি করার জায়গা। এখনকার শিশুরা কি পাড়া-প্রতিবেশীর কোলে ওঠে? বিভিন্ন রকম মানুষের শরীরের গন্ধ কিংবা বিভিন্ন রকম মায়া আহরণের সুযোগ পায়? আধুনিক যুগে একটি বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কত দিন বা কত সময় প্রকৃতির দেওয়া সুভাসিত মাটিতে পদলেহন, এমনকি নিজের শরীর নিয়ে গড়াগড়ি করতে পারে? বছর কয়েক আগেও কোমলমতি শিশু কাঁচাঘর কিংবা বাড়ির উঠানে প্রস্রাব-পায়খানা করত, খেলা করত, নিজের গায়ে কাদামাটি মাখত। এসব এখন শুধুই স্বপ্ন। এখন এসব নিতান্তই বর্জ্য আবর্জনা, বিভিন্ন রকম রোগের কারণ।
একদিকে প্রযুক্তির কল্যাণ থাকলে অপর দিকে আছে বিপদ।
এই সময়ের বাবা মায়েরা বেশ অলস, ঘরের ছোট বাচ্চা থাকলে একটু দুষ্টুমী কিংবা বাবা-মাকে বিরক্ত করলে হাতে মোবাইল, ট্যাব কিংবা টিভিতে ইন্টারনেট দিয়ে বসিয়ে রাখে ঘন্টার পর ঘন্টা। ছোট বাচ্চাদের স্বভাব-সুলভেই একটু দুষ্টুমী থাকে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বাচ্চাদের চাঞ্চল্য, প্রাণবন্ত দুষ্টুমি ভবিষ্যতে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেয়ে, অভিভাবকরা তাদের সময় ও শ্রম বাচানোর জন্য না জেনে প্রযুক্তির যে সহায়তা নেয়, তার পরিণাম ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তারদের মতে, টিভি, মোবাইল, ট্যাব বাচ্চাদের দেওয়ার ফলে তাদের মানসিক বিকাশ ও কথা বলা পিছিয়ে যাচ্ছে বহুলাংশে। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ ঠিকমত হচ্ছেনা। যে বয়সে সে থাকবে অন্যদের ইন্টার্যাকশনে, অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলবে, নতুন অনেক কিছু হাতে ধরে শিখবে সে বয়সে এই প্রযুক্তিই কাল হয়ে দাড়াতে পারে ছোট্ট শিশুটির জীবনে।
একটা সময় বিকাল হলেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা বাড়ির পাশের মাঠে পাড়ি জমাত বিভিন্ন রকম খেলায় মাতবে বলে। গ্রাম বা মহল্লায় ছুটোছুটিতে মেতে থাকত শিশু-কিশোররা। ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্দা, ডাঙ্গুলি, মার্বেল, ক্রামবোর্ডসহ নানা খেলায় বুদ হয়ে থাকত তারা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই পাড়ার মা-খালারা সন্তানের খোঁজে বেরিয়ে পড়ত, ডাকাডাকি শুরু করত এখানে-ওখানে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বেত বা নিজের হাতে মারতে মারতে বাসায় আনতেন দুষ্ট সন্তানকে।
স্কুল-কলেজে শিক্ষক আসতে দেরি করলে অথবা শিক্ষক চলে গেলে নানা রকম দুষ্টমিতে মেতে উঠত ছাত্রছাত্রীরা। এর মাঝে কত যে আনন্দ তা বর্তমান শিক্ষার্থীরা কি আর বোঝে? সকাল-সন্ধ্যায় গল্পের বইয়ে ডুব দেওয়া, বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাওয়া ও প্রবীণদের কাছ থেকে গল্প শোনা ছিল তাদের কাছে এক ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা, জীবন ছিল অন্যরকম।
সেই বয়সে এসে এ জামানার ছেলে-মেয়েরা বিনোদনের নাম করে সারাদিন বুদ হয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, বিগো ইত্যাদি। প্রথম কথা, এই সোশ্যাল মিডিয়া জিনিসটার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নাই, যার কারণে অপসংস্কৃতি, অশ্লীলতা, নেতিবাচক ও মিথ্যা তথ্য, ও এমন কিছু কন্টেন্ট পাব্লিশ হয় যা প্রতিনিয়ত অল্প বয়সীদের বিপদ্গামী করে তোলে। দ্বিতীয়ত এই কন্টেন্ট পাবলিশের কারণও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, যে পাবলিশ করে সে ভিউয়ের উপর মোটা অংকের টাকা পায়। কিংবা যে এই কন্টেন্টগুলো করে সে টাকা পায়। বিপদ হচ্ছে যে, কন্টেন্ট বানানোর নাম করে বেশি ভিউ এর আসায় মানদণ্ডহীনভাবে তৈরি এই ডিজিটাল কন্টেন্ট-এর উপর কন্ট্রোল না থাকায় এ যুগে একটি শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের মানুষের কাছে পশ্চিমা সমাজের উন্নতির ফলাফল এই সোশ্যাল মিডিয়া পৌঁছে দিচ্ছে নির্বিচারে, যার ফলে অল্প বয়সীরা এমন কিছু শিক্ষা পাচ্ছে যা সমাজের “ট্যাবু” বলে বিবেচিত। তৃতীয়ত, কিছু কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সোশ্যাল মিডিয়ার সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমাদের হাতে, বিশ্ববাসীকে বিক্ষিপ্ত রাখতে। এমনও রিপোর্ট আছে যার মতে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন জাল বিছে তথ্য হাতিয়ে নেয় গ্রাহকদের। এ নিয়ে মার্ক জুকারবার্গ থেকে শুরু করে আরো অনেককেই আমেরিকান কংগ্রেসের সামনে বসে জবাবদিহি করতে হয়েছে।
আমরা আন্তর্জাতিক কোন বিষয়ের তর্কে যাবোনা
একটি পরিণত, পরিপক্ক ও শুশীল মানুষ হিসাবে একটি শিশুকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন সঠিক পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সুস্থ বিনোদনের। ছোট থেকেই বাড়ির বাইরে খেলাধুলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেলাধুলার ফলে স্বাস্থ্য থাকে ফিট ও মন থাকে সজীব। খেলাধুলার আরও কিছু বিষয় হচ্ছে, খেলাধুলার ফলে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি তৈরি হয়, বাচ্চারা একসাথে থাকার ও হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝে, ও একেওপরের সার্থের ব্যাপারে অবগত হয়। তারা চিন্তা করতে শেখে, সৃজনশীল হয়। যেগুলি ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্র্যাম দিতে পারেনা।
এর পাশাপাশি বাসার সবাই মিলে একটি সুন্দর ও পরিবারবান্ধব সিনেমা দেখা যেতে পারে বিনোদনের জন্য। পরিবারের সবাই মিলে সময় কাটানো বাচ্চাদের জন্য অমূল্য সম্পদ।
বাচ্চারা বড়দের গল্প শুনবে, কল্পনার জগতে হারিয়ে যাবে- এটাই হওয়া উচিত ছিল প্রতিটি পরিবারে হাতে মোবাইল-ট্যাব দেওয়ার স্থলে।
অবসর সময়ে আগে পরিবারের সবাই মিলে বাইরে পিকনিক-ঘুড়তে যেত, যার প্রচল এখন কমে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজের মানুষের ভয়ানক ডিজিটাল প্রোগ্রাম আসক্তির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো-হৃদয় মাঝে অতিমাত্রায় অমানবিকতার উপস্থিতি, অসামজিকতা, মানসিক বৈকল্য, বেকারত্ব, কু-সামাজিকীকরণ, এটাকে ফ্যাশন হিসেবে নেওয়া, সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, সামাজিকীকরণের মাধ্যমসমূহ প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া, সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, মাঠ-পার্কের অভাব হেতু খেলাধুলার প্রতি অনীহা, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব, যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি, জীবনে প্রকৃত ধর্ম চর্চার অভাব ও উক্ত শিক্ষা বাস্তবায়নের অভাব, নিঃসঙ্গতা, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, আদব শিক্ষার অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ইত্যাদি। মোট কথা সুষ্ঠু সামাজিক বিকাশের জন্য আদর্শমান কৃষ্টি-কালচারের অনুপস্থিতি (সর্বপর্যায়ে)। ফলতঃ বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার, পর্নগ্রাফি, ডিজিটাল প্রযুক্তির নানান রকমের খারাপ প্রোগ্রাম মানুষের মনোজগতকে গ্রাস করার প্রয়াস পাচ্ছে। সঙ্গগত কারণেই এগুলোর প্রচার ও প্রসারে সেন্সর করা উচিত।
ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে জীবন এক ভঙ্গুর ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে আছে। কী এক বেদনাদায়ক অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি অথবা সমগ্র মানবজাতি এমনকি দেশবাসী! যার ফলফল চারিদিকে শুধু যদ্ধ আর যুদ্ধ। একমাত্র সেবা, ত্যাগে, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানবধর্মের প্রতি সু-বিচার করে এই অবস্থা হতে উত্তরণ পাওয়া যেতে পারে। মানুষকে সু-বিবেচনা প্রসূত বোধোদয়ের পরিচয় দিতে হবে, স্বার্থপর, সহিংস হলে হবে না। আরো প্রয়োজন নিঃঅহংবাদী নীতির প্রচার ও প্রসার। একটি সুন্দর মনই পারে সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে।
২০০ বছরের শাসনে যে কাজটি সাম্রাজ্যবাদীরা করতে পারেনি, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তা-ই হচ্ছে স্বচ্ছন্দে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের প্রাচীন অসভ্য সংস্কৃতি তথা নগ্নতা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চাপে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য, ভেঙ্গে পড়ছে সমাজ মান। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অশ্লীলতাই এখন সবার কাছে আধুনিকতার মানদণ্ড। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ফলে শিশু-কিশোররা গণমাধ্যম দেখে নিজেদের বাস্তব জগতের নায়ক ভাবতে থাকে। মুঠোফোনের অযৌক্তিক ব্যবহার তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ বাড়াচ্ছে। সব বয়সের মানুষের হাতে মুঠোফোন থাকায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে মুঠোফোন।
ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকাল পরকীয়া, পড়ালেখায় অমনোযোগীতা, অসহিষ্ণুতাসহ , অসমপ্রেমের জোয়ারে ভেসেছে সমাজ। যা সকল প্রকার সহিংসতার অন্যতম কারণ। সর্বত্র এখন চলছে পরকীয়া প্রেম সহিংসতা, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক ডিজিটাল দুর্নীতিই মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। আর সমাজে এ ধারার অপ্রতিরোধ্য উত্থানের ফলে-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে সর্বত্র বাজছে ভাঙ্গনের সুর। যা প্রকারান্তরে সহিংসতা, ভংগুর পরিবারে রূপ নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে কদর বাড়ছে পাপারাজিদের, বিকলাঙ্গবাদীদের। শিথিল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। মানুষের মাঝে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে সভ্যতাই আজ হুমকির মুখে পড়েছে। তবে এর প্রধান শিকার হচ্ছে প্রায় পুরো মানব সমাজ। দিন দিন যেন সবাই আরও নতুন উদ্যোমে ধরা দিচ্ছে-পরকীয়া, সাইবার অপরাধের মায়াজালে। এখন শহুরে-গ্রাম্য বধূর পরকীয়া প্রেম, বিয়ে ও সাইবার অপরাধের ঘটনায় আইনি লড়াই হচ্ছে সর্বত্র। এক জনের বধূ বা স্বামী র্দীর্ঘদিন ঘর সংসার করার পর স্বামী বা স্ত্রীকে ছেড়ে প্রেমিক বা অবৈধ প্রেয়সীকে বিয়ের ঘটনায় বাংলার প্রায় এলাকাতেই আজ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে অরাজকতায় রূপ নিচ্ছে। এই চাঞ্চল্য, অরাজকতা আজ দেখা দিয়েছে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে। এ ধারায় আর ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় যে, সমাজ পরিবার এখন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক অপরাধ , পরকীয়া, অসম প্রেমের দিকে ঝুঁকছে বেশ জোরে শোরেই। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদেরকে সচেতন হয়ে সঙ্গী বা সঙ্গীনি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দৃষ্টির প্রসারতা বাড়াতে হবে। যাতে করে সঠিক লোক নির্বাচনে কোন ভুল না হয়। বিনোদনের আর অবসরের জন্য প্রয়াস থাকবে ছোট থেকেই, শুরুটা হতে হবে পরিবার থেকেই। একমাত্র একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থাই দিতে পারে একটি সুস্থ জাতি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের উপর নজর দিতে হবে, সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়াতে হবে।
লেখক প্রকাশ প্রতিদিন সেবক.কমের
বিএসসি ইন ইইই
এমবিএ(ঢাবি)