
এক সময়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের আলোচিত জুটি ছিলেন ইমন-মামুন। তবে তাদের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য ও প্রকট। দ্বন্দ্বের জেরেই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন হত্যার পরিকল্পনা করেন মামুনকে।
ইমন তার ঘনিষ্ঠ সন্ত্রাসী রনি ফারুকের সহায়তায় একাধিকবার মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। মামুনের মামলার হাজিরার দিন ধার্য ছিল ১০ নভেম্বর। ওই দিন পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় মামুনকে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুন (৫৫) হত্যায় অংশ নেওয়া দুই শ্যুটারসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তার দুই শ্যুটার হলেন- ফারুক ওরফে কুত্তা ফারুক ও রবিন। গ্রেপ্তার বাকি তিনজন হলেন- ইউসুফ, রুবেল ও শামীম।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার ফারুক ও রবিন ছিলেন পেশাদার শ্যুটার। গ্রেপ্তারের সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি পিস্তল, হত্যার পারিশ্রমিকের নগদ টাকা ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
ডিবি জানায়, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী রনি। তিনি ছিলেন এক সময়ের মুদি দোকানি, বর্তমানে কাফরুলের বাসিন্দা এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী। আন্ডারওয়ার্ল্ডের আলোচিত জুটি ইমন-মামুনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য ও প্রকট ছিল। হত্যাকাণ্ডের জন্য রনি নিজে দুই লাখ টাকা দেন এবং অস্ত্রও সরবরাহ করেন। মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্য বিস্তার নিয়েই এই হত্যাকাণ্ড হয়। রনি পলাতক রয়েছেন; তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
বুধবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির ডিবিপ্রধান মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, গত ১০ নভেম্বর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রবেশপথে দুজন অস্ত্রধারীর গুলিতে তারিক সাইফ মামুন গুরুতর জখম হন। পরে তাকে প্রথমে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডিবিপ্রধান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ ছায়া তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়। গোয়েন্দা তথ্য ও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়। পরে তাদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে সিলেট সদর, নরসিংদী ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও আলামত উদ্ধার করা হয়।
অভিযানকালে আসামি ফারুক, রবিন, শামীম ও রুবেলকে নরসিংদী সদর থানার ভেলানগর এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তল্লাশিতে ফারুক ও রবিনের কাছ থেকে নগদ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকা উদ্ধার করা হয়; যা রনি তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রদান করেছিলেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর ফারুক ও রবিন তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র ও অব্যবহৃত গুলি রনির নির্দেশে রেন্ট-এ-কারের চালক রুবেলের কাছে দেয়। রুবেল অস্ত্র ও গুলি পাওয়ার পর তা রনিকে মোবাইল ফোনে জানায়।
রুবেলকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপর আসামি ইউসুফের (পেশায় দর্জি) বাসার মেঝে থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি ও ২টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তার ইউসুফ ও রুবেল জানান, হত্যাকাণ্ডের দিন রুবেল অস্ত্র-গুলি ভর্তি একটি ব্যাগ ইউসুফকে তার কাছে রাখার জন্য বুঝিয়ে দিয়ে যান।
ডিবি জানায়, এক সময়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের আলোচিত জুটি ইমন-মামুনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য ও প্রকট ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের ঘনিষ্ঠ রনি ফারুকের সহায়তায় একাধিকবার মামুনকে হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে তারা নতুন পরিকল্পনা করে ১০ নভেম্বরকে হত্যার দিন হিসেবে নির্ধারণ করেন। যেহেতু ওই দিন মামুনের মামলায় হাজিরার দিন ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগের দিন সন্ধ্যায় রনি তার বাসায় সন্ত্রাসী রবিনকে ডেকে নেন।
ডিবিপ্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ নভেম্বর রনি সকাল ৯টার দিকে রবিনকে ফোন দিয়ে জজকোর্ট এলাকায় যেতে বলেন। সে অনুযায়ী সকাল ১০টার দিকে রবিন তার বন্ধু শামীমের ড্রাইভিংয়ে সেখানে যান হত্যার মিশনে অংশ নিতে।
অন্যদিকে রনির নির্দেশে ফারুকসহ সুমন, কামাল ও আরও ১/২ জন জজকোর্ট এলাকায় উপস্থিত হন। রনির নির্দেশে ফারুক অটোরিকশাযোগে সেখানে যান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে সুমন ও ফারুককে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন রনি। একপর্যায়ে সুমন ও রনির মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। রনি তখন সুমনের কাছ থেকে দুটি পিস্তল নিয়ে একটি ফারুক ও অপরটি রবিনকে দিয়ে হত্যার মিশনে পাঠান।
অপর পলাতক কামালের দায়িত্ব ছিল মামুনকে অনুসরণ করে তার গতিবিধি জানানো। সে অনুযায়ী মামুনের সঙ্গে থেকে সংকেত পেয়ে ফারুক ও রবিনকে খবর দেন। এরপর তারা মামুনকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে বেড়িবাঁধ হয়ে রায়েরবাজারে গিয়ে রনির নির্দেশে রুবেলের মাধ্যমে অস্ত্র-গুলি ইউসুফের কাছে জমা রাখেন। পরবর্তীতে রনি রুবেলের মাধ্যমে ফারুক ও রবিনকে ১ লাখ করে টাকা দেন।
পরে রনির পরিকল্পনা ও নির্দেশে রুবেলের সহায়তায় ফারুক, রবিন ও শামীমকে ঢাকা থেকে সিলেটে পাঠানো হয়। তাদের সঙ্গে রুবেলও সফরসঙ্গী হন। ঘটনার পর রনি তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে নেন; যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শনাক্ত বা অনুসরণ করতে না পারে।
তারা প্রথমে সিলেটে গিয়ে রবিন ও রুবেলের প্রচেষ্টায় ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সেখানে প্রবেশে সুবিধা না হওয়ায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করে ঢাকার পথে রওনা দেন। পথে ডিবি তাদের গ্রেপ্তার করে।
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত