যশোরের সাবেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার। তার নানা অপকর্মের খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এমন একটি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা ভিন্নমতের হওয়ার কারণে শাহীন চাকলাদারের রোষানলে পড়ে। এমনকি সেই বাড়িতে বাইরের কেউ গেলে পর্যন্ত নানা রকম হেনস্তা করা হতো। বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ায় চার বছর বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়নি কলেজপড়ুয়া মেয়েকে। হয়রানি থেকে বাঁচতে পুলিশকে দিতে হয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা। এতে পরিবারটি আজ নিঃস্ব।
বলছিলাম ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত যশোর সদরের খড়কি গ্রামের মোয়াজ্জেমুল হক নান্নুর পরিবারের কথা। গত ১২ বছর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে পরিবারটি।
চার বছর বাড়িছাড়া সুমাইয়া!
নান্নুর মেয়ে উম্মে সুমাইয়া তখন সবে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন। বাবা হেফাজতের সমাবেশে গিয়ে মারা যান। সেই কষ্ট মেনে নিতে পারেননি তিনি। বাড়িতে তখন অনেক লোকজন। এসেছিলেন গণমাধ্যম কর্মীরাও। এক পর্যায়ে তারা জানতে চান বাবার মৃত্যুতে তার কোনো কিছু বলার আছে কি না! সেদিন গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন চান। আর তার এই কথাই জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ প্রশাসন। পুরো বাড়ি পুলিশ, র্যাব ও ডিবি সদস্যরা ঘিরে ফেলেন। তারা তাকে খুঁজতে থাকেন। গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হয়। কিন্তু এর আগে সুমাইয়ার মামাতো ভাই তাকে সেখান থেকে অন্যত্র নিয়ে যান। ফলে সেদিন সুমাইয়া ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। কিন্তু সেই বাড়িতে আর চার বছরেও ফেরা হয়নি তার। যদিও পরে যেতেন, তবে খুব গোপনে। তাও রাতের আঁধারে। সকালে গোপনে আবারও ঢাকায় ফিরতেন। এই চারটি বছর তাকে রাজধানীর মিরপুর-১১ ও ১২, মোহাম্মদপুর, আদাবর এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।
ওসি বদল হলেই থানায় টাকা দিতে হতো
সুমাইয়া বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে আত্মগোপনে থেকেও শান্তিতে ছিলাম না। পুলিশ প্রায় সময় বাড়িতে আমাকে খোঁজার জন্য আসত। ফলে এক সময় দেখা গেল পুলিশ এলেই টাকা দিতে হতো। এছাড়াও থানার ওসি বদল হলেই আমরা ধরে নিতাম টাকা দিতে হবে। এসব টাকা থানার সেকেন্ড অফিসারকে দেওয়া হতো। পরে তিনি থানার ওসিকে দিতেন। এভাবে ১২ বছর টাকা দিতে হয়েছে। শুধু পুলিশি হয়রানি ও আমাদের বিরুদ্ধে যাতে কোনো ধরনের মামলা বা ওয়ারেন্ট না হয়। কারণ আমার বাবাতো হেফাজতের সমাবেশে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। এর জন্য আমরা সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতাম।
ভুক্তভোগীর মেয়ে সুমাইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি তখন কলেজে যেতাম। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর কলেজে গিয়ে দেখি শাহীন চাকলাদার। তখন তিনি আমার পথ আটকান। সঙ্গে তার লোকজন। সবার সামনে বলতে থাকেন, তুমি কি এই কলেজে পড়ার যোগ্যতা রাখো! এরপর তিনি আমাকে কলেজ থেকে বের করে দেন। সেই সাথে উপস্থিত সবাইকে বলে দেন, তোমরা এই মেয়ের সঙ্গে কখনো কেউ ভুলেও মিশবা না। ফলে তিনি কলেজে গেলেও তার সহপাঠীরা ভয়ে তার সঙ্গে মিশতেন না। কথা বলতেন না।
সুমাইয়া জানান, তার পরিবারটি তখন দিশেহারা। বাবা নেই। আয়ও নেই। বাবা একটি মসজিদে ইমামতি ও দর্জির কাজ করতেন। তাতে ভালোই চলত সংসার। কিন্তু বাবাকে হারিয়ে তারা চোখে-মুখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেন। ভাই-বোন তারা পাঁচজন। তিন বোন ও দুই ভাই। বাবা মারা গেলেও তারা পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে থাকেন। মেধাবী ও বাবা দরিদ্র হওয়ায় স্কুল-কলেজে নানা সুবিধা পেতেন। কিন্তু সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার সেটাও বন্ধ করে দেন। তার লোকজন স্কুল-কলেজের প্রধানদের বলে এই কাজটি করেছিল বলে জানান সুমাইয়া। এক পর্যায়ে তার ছোট ভাইটাকে কোথায় রাখা হবে, কীভাবে পড়াশোনা করবে এই চিন্তা দেখা দেয়। কিন্তু সেই সময় তার দায়িত্ব নেন স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর লোকজন। তারা তাকে একটি মাদরাসায় রেখে এখনো পড়াশোনা করাচ্ছেন বলে জানান সুমাইয়া।
সাজানো পরিবার তছনছ!
সুমাইয়াদের দুঃখের দিন কবে শেষ হবে তারা তা জানে না। বাবার মৃত্যুর পর বড় বোনের সংসার ভেঙেছে। সেই বোন এখন তার মায়ের কাছেই থাকেন। সুমাইয়ার বাবা তার দাদার কাছে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন তারও কিছু অংশ লিখে নিয়েছেন তারা চাচা। আপন মানুষেরাও তাদের সঙ্গে অনেকটা প্রতারণা করেছেন বলে জানান সুমাইয়া।
সুমাইয়া বলছিলেন, তার বাবার মৃত্যুর পর হেফাজতে থেকে দুবার কিছু সাহায্য করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা আর কোনো খোঁজই রাখেনি। এখন পরিবারটিকে স্থানীয় জামায়াত নেতা কিছু সহযোগিতা করেন। আর তার মা ও বোন বাবার রেখে যাওয়া দর্জির কাজ করে যা আয় হয় তাতেই চলে সংসারের চাকা। যদিও সেই আয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তাদের। একটি সাজানো গোছানো সংসার তছনছ করে দেওয়ার পেছনে যারা জড়িত, সেই শাহীন চাকলাদারসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করেন সুমাইয়া।