
ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার রজনী বোস লেনে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) নামের এক ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যা করে মৃত অবস্থায় আরও মারা হয় মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের ভেতরে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হত্যাকাণ্ডের সময় সোহাগের ওপর কিল-ঘুষি মারা হয়, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় এবং পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়। পরে তার মৃতদেহের ওপর লাফিয়ে পা দিয়ে লাথি মেরে খুনিরা উল্লাস করে।
সোহাগকে বাঁচাতে তার দুই কর্মচারী অনুনয় করে, পা ধরে কান্নাকাটি করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। চারপাশে বহু মানুষ থাকলেও খুনিদের আতঙ্কে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, দোকানে হত্যার পর মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে আবার কেন মারা হলো, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগের এই হত্যাকাণ্ডে দেশের মানুষ হতবাক হয়ে পড়েছে। সামাজিকমাধ্যম, রাজনীতি, সাধারণ মানুষসহ সর্বস্তরে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই ঘটনায় সরব হয়েছে, বিবৃতি দিচ্ছে।
রজনী বোস লেনের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা নিশ্চিত করেছেন, ‘ধর ধর’ বলে স্লোগান দিয়ে সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। সেখানে তাকে মারধর করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পরে মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতর। তবে কেন তাকে মেরে ফেলার পরও মরদেহ নিয়ে আরও নির্যাতন চালানো হলো, তার সঠিক ব্যাখ্যা মেলেনি।
পুলিশ জানিয়েছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই এই হত্যা হয়েছে। কিন্তু নিহতের পরিবার বলছে, এটি দোকান দখল ও চাঁদা না দেওয়ায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোহাগ হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। তারা বলেন, যেভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছাড়া সম্ভব নয়। একটি মানুষ মারা যাওয়ার পর তার ওপর এত নির্মমতা সাধারণ কোনো ঘটনার কারণে হয় না।
এদিকে যে স্থানে সোহাগকে মারা হয়েছে, তার কাছেই ছিল আনসার ক্যাম্প। ঘটনার সময় অনেক আনসার সদস্য ক্যাম্পে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া লোকজন এলাকা পরিচিত। তারা এতটাই ভয়ংকর যে, কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করে না।
নিহত সোহাগ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি আগে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সাবেক এমপি হাজী সেলিমের হয়ে চাঁদা তুলতেন। অনেক ছবিতে তাকে হাজী সেলিমের সঙ্গেও দেখা গেছে। পরে তিনি নাকি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, সোহাগ ভাঙাড়ি ব্যবসার পাশাপাশি পুরনো সাদা বৈদ্যুতিক তার কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার দুটি দোকান ছিল—একটি রজনী বোস লেনে, অন্যটি চায়নাপট্টিতে।
সোহাগ ও মহিন পূর্বপরিচিত ছিলেন। এলাকাটিতে তামার তার ও সাদা তারের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এই অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মহিন, অপু, টিটু, রজ্জব আলী পিন্টুসহ একটি চক্র ব্যবসার ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। না হলে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা চাঁদা দিতে বলে। এই দ্বন্দ্বের জেরে সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলিও করা হয়। এরপর তিন দিন দোকান বন্ধ রাখেন সোহাগ। পরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সোহাগকে হত্যা করেছে এমন দু’জনের নাম উঠে এসেছে—যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহমুদুল হাসান মহিন ও ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা অপু দাস। তারা এলাকায় চাঁদাবাজির একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। মিটফোর্ড, চায়নাপট্টি, ফুটপাথ, ওষুধ ব্যবসা, সবখানেই তাদের চাঁদাবাজি চলতো। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি শুরু করে।
এদিকে, মামলার মূল তিন আসামিকে এজাহার থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না বলেন, যাদের ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভিতে দেখা গেছে, তাদের বাদ দিয়ে মামলায় নিরপরাধ তিনজনকে আসামি করা হয়েছে।
নিহত সোহাগের মেয়ে মিম বলেন, এজাহার তৈরির সময় পুলিশের কাছে যে খসড়া তারা জমা দিয়েছিলেন, তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি জানান, মূল তিন খুনির নাম বাদ দিয়ে অন্যদের আসামি করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশ তাদের মাকে (বাদী) বুঝিয়ে একটি ভিন্ন নথিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। তখন তারা আবেগপ্রবণ ছিলেন। পুলিশ পরে বলে, সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি।
কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, এজাহার তো তারা দিয়েছে, আমরা নয়। তারা কি অশিক্ষিত? না। তারা ভালো করে দেখে বুঝেই দিয়েছে। এখন অন্য কিছু বললে হবে না।
অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, চার দিন পেরিয়ে গেলেও তারা এখনো আতঙ্কে। কেউ মুখ খুলছে না। অনেকে তথ্য দিতে চাইলেও পরিবার ও নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছু বলছে না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মিটফোর্ডের রজনী বোস লেন ভাঙাড়ি ব্যবসার কেন্দ্র। সারা দেশ থেকে এখানে প্লাস্টিক, তামা, দস্তার পণ্য আসে। সঙ্গে রয়েছে অবৈধ চোরাই তারের ব্যবসা। এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই হত্যা করা হয় সোহাগকে। একজন ব্যবসায়ী বলেন, সবাই জানে কারা খুন করেছে। কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না। কারণ, নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আরেক ব্যবসায়ী জানান, ২০-২৫ জনের একটি অস্ত্রধারী দল সোহাগকে দোকান থেকে ধরে মেরে মেরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এলাকার অনেক বাড়িতে সিসিটিভি রয়েছে। ফুটেজ দেখে খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব। তিনি বলেন, যারা খুন করেছে, সবাই পরিচিত। কিন্তু জীবন রক্ষার দায়ে কেউ কিছু বলবে না।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিকেল বেলায় চিৎকার শুনে তিনি দেখতে পান সোহাগকে কয়েকজন মেরে ফেলছে। তিনি বলেন, এই লোকগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তাই কেউ কিছু বলে না। প্রতিদিন রাস্তার দোকান থেকে চাঁদা আদায় হতো। প্রশাসন এতদিন জানত না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, হঠাৎ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলো কেন? প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কি দোকান বসেছে?
স্থানীয়রা বলছেন, এ ঘটনায় প্রশাসনও দায় এড়াতে পারে না। কারণ প্রশাসন সবকিছু জানতো। একজন বলেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বলে যেটা পুলিশ বলছে, তা শিশুও বিশ্বাস করবে না। তাহলে এত মানুষ কীভাবে খুনে জড়িত হয়?
এদিকে, সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে মিটফোর্ডে বিক্ষোভ করে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, শুরু থেকেই যদি চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না। তিনি বলেন, অপরাধী যেই হোক, আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, রাজনীতির ছত্রছায়ায় অপরাধীরা নিরাপদ থাকে বলেই তারা বেপরোয়া হয়। তৃণমূল রাজনীতিতে বহিষ্কারের ভয় থাকে না। দল ক্ষমতায় আসবে এই আশায় তারা অপরাধ করে সুবিধা নেয়। এটা বন্ধ না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে।