এই বিশ্বের মানুষের কাছে আজও এক রহস্যময় নগরীর নাম আটলান্টিস। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এখনো শহরটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। শহরটির অস্তিত্ব ছিল, নাকি তা শুধুই কবির কল্পনা- তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। এই নগরকে নিয়ে লেখা হয়েছে কত গল্প-কবিতা-উপন্যাস! বিজ্ঞানী ও গবেষকদের দল এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই অজানা শহরটিকে। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত সমাধান না হওয়া যত রহস্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো এই আটলান্টিস।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর লেখা থেকেই প্রথম জানা যায় আটলান্টিস শহরের কথা। টিমেউস ও ক্রিটিয়াস নামে প্লেটোর দুটি ‘ডায়ালগ’ এ আটলান্টিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৩৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ দার্শনিক প্লেটো তার শিষ্যদের নিখুঁতভাবে এই নগরটির কথা বলে গেছেন।
প্লেটো তার লেখায় জানিয়েছেন যে, আটলান্টিসের কথা প্রথম জানতে পারেন গ্রিক মহাজ্ঞানী সোলোন। মহাজ্ঞানী সোলোন তথ্যটি আবার মিশরীয় এক ধর্মযাজকের কাছ থেকে পান। মিশর থেকে ফিরে এসে সোলোন তার এক আত্মীয় ড্রপাইডসের কাছে আটলান্টিসের গল্পটি বলেন। পরম্পরায় গল্পটি ড্রপাইডস তার সন্তান, তার প্রপৌত্র ক্রিটিয়াস গল্পটি প্লেটোর কাছে ব্যক্ত করেন।
অনেকে মনে করে থাকেন, আটলান্টিক মহাসাগরের কাছে অবস্থিত হওয়ায় নগরটির নামকরণ হয়েছিল আটলান্টিস। প্লেটোর বর্ণনা অনুযায়ী, সমুদ্রের দেবতা পোসাইডন ছিলেন আটলান্টিসের রাজা। তার স্ত্রী ক্লিওটার ছিলেন খুব সুন্দরী। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে পাহাড়ের মাথায় স্ত্রীর জন্য এক অপরূপ প্রাসাদ তৈরি করেন পোসাইডন। তাদের ছিল পাঁচ জোড়া যমজ সন্তান। সমুদ্র দেবতা তার দশ সন্তানকে দ্বীপের বিভিন্ন অংশ শাসনের ভার দিলেন। তার বড় যমজ সন্তানের একজন এটলাসকে দ্বীপের একটি অংশের শাসনের ভার দিলেন। তার নামানুসারে দ্বীপের সেই অংশের নাম হয় আটলান্টিস। পরে এটলাস পুরো দ্বীপ এবং সমুদ্রের চারপাশের অঞ্চল নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। এরপরেই পুরো দ্বীপের নাম তার নামে হয়ে যায় আটলান্টিস।
প্লেটোর লেখা থেকে জানা যায়, আটলান্টিস ছিল এক স্বর্গোদ্যান। তা ছিল এক ‘সব পেয়েছি’র দেশ। অত্যন্ত উর্বর ছিল সেখানকার মাটি, সেখানে রকমারি ফসল ফলাতো কৃষকরা। আর তাতে ফলতো নানা ফলমূল, শাকসবজি। প্রচুর পরিমাণে ফসল ফলতো বলে নগরীতে কোনো অভাব ছিল না। মনমাতানো গন্ধে ভরা রং-বেরঙের সুন্দর ফুলে ভরে থাকতো সবুজ এই রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। পাহাড়, সমুদ্র আর অরণ্যে ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই রাজ্যে সোনা, রূপো, তামা ইত্যাদি খনিজ সম্পদেরও কোনো অভাব ছিল না। সেচ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ পেরিয়ে নীলচে পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল কৃষকদের বাড়ি।
আটলান্টিস নগর ঘিরে ছিল সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, বন্দর, মন্দির। সোনা ও রূপার কারুকার্যে ভরা সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। আর ছিল এক সমুদ্র দেবতার মূর্তি। রাজধানীটি ছিল এক সবুজে ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায়। সেই পাহাড়ের চারিদিক ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটি পরিখা। পরিখাগুলো আবার পরস্পরের সাথে খাল দিয়ে যুক্ত ছিল। বাইরের পরিখাটি খাল দিয়ে যুক্ত ছিল সমুদ্রের সাথে। সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এ খালগুলো ব্যবহার করা হতো।
কিন্তু অনেক গবেষকই এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, প্লেটো যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সময়েরও নয় হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগের শুরুর দিকে এরকম উন্নত বুদ্ধিদীপ্ত নৌশক্তিসম্পন্ন সভ্যতা পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সত্যিই অকল্পনীয়।
কিন্তু পরবর্তীতে অনেক গবেষকই আটলান্টিসের ধ্বংস হওয়া নিয়ে নানা মত রেখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রিক পুরাতাত্ত্বিক অ্যাঞ্জেলোস গ্যালানোপুলোসের অভিমত। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে তার তত্ত্বটি প্রকাশ পেলে চমকে গিয়েছিলেন সবাই। তিনি বললেন, ১,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এক ভয়ানক আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরের সান্তোরিনি দ্বীপে। আগ্নেয়গিরির হঠাৎ জেগে ওঠা ও তার দরুণ এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ও প্রবল জলোচ্ছাসের সৃষ্টি হয় পুরো নগর জুড়ে। ফলে এক রাতের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে তলিয়ে যায় এই শহর। আর সেই সাথে মুছে যায় এক উন্নত সভ্যতার যত চিহ্ন।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সমুদ্র গবেষক রবার্ট বালার্ডের মতে, আটলান্টিসের এই ধ্বংসের তথ্যটি সঠিক হতে পারে। কারণ, ইতিহাসের এই সময়টায় বড় ধরনের বন্যা এবং আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের তথ্য পাওয়া গেছে।
আটলান্টিস নগরটি কোথায় ছিল তা নিয়ে জল্পনার কোনো শেষ নেই। আটলান্টিসের খোঁজে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর অনুসন্ধান চলেছে এবং এখনো চলছে। তবে এখনো এর প্রকৃত অবস্থান কোথায় ছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানকে হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তার পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তারা তুলে ধরতে পারেননি। অনেকের বিশ্বাস, গ্রিক দ্বীপ ক্রিটের কাছাকাছি ছিল আটলান্টিস।
অনেকের ধারণা, সমুদ্রের নিচে কোথাও এখনো রয়েছে সেই কল্পনার নগরী;
তবে কোনো কোনো গবেষকের মতে, গ্রিসের সান্তোরিনি শহরটিই হচ্ছে অ্যাটলান্টিস। আবার কারো মতে, বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার কাছে, কারো ভাবনায় আফ্রিকায়ও নাকি থাকতে পারে আটলান্টিস। কারো কারো মতে, আটলান্টিস গ্রিক পুরাণের শহর টান্টালিসও হতে পারে। কারণ হিসাবে শোনা যায়, জিউস রেগে গিয়ে বজ্রপাত করেন টান্টালিসের উপরেও। আবার ফ্লোরিডার উপকূলে বিমিনি দ্বীপের পাশে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের একটি পথের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে প্লেটোর দেয়া তথ্যমতে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে উৎপত্তি হওয়া একটি দ্বীপই হচ্ছে আটলান্টিস। বলা হয়ে থাকে, হারকিউলিস পিলার নামে এক ছোট দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল তার পাশে। বর্তমানে তা জিব্রাল্টার প্রণালী হিসেবে পরিচিত। তাই অনেকে মনে করে থাকেন, জিব্রাল্টার প্রণালীর কাছাকাছি কোথাও ছিল আটলান্টিস শহরটি।
১৯৬৮ সালে এগার ক্যাচি তার বই ‘On Atlantis’ এ উল্লেখ করেন, মিশরের নীলনদ এবং স্ফিংস এর মূর্তির মাঝে হল অব রেকর্ডস যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানেই পাওয়া যেতে পারে আটলান্টিসের ধ্বংসাবশেষ।
২০১১ সালে হাটফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ রিচার্ড ফ্রেউন্ড ও তার দল কয়েকটি শহরের সন্ধান পান যেখানে আটলান্টিস নগরটি ছিল বলে মনে করা হয়। স্পেনের এক শহর কাদিজের উত্তরে ডোনা ন্যাশনাল পার্কের সোয়াম্প ফরেস্টের নীচে এই শহরগুলো খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে আটলান্টিসের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে কোনো গবেষকই এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
স্পেনের ডোনা ন্যাশনাল পার্কের সোয়াম ফরেস্টের নীচে আটলান্টিসের খোঁজ পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ রিচার্ড ফ্রেউন্ড ও তার দল
আটলান্টিস নিয়ে প্লেটোর এই কাহিনী কোনো পৌরাণিক কল্পকাহিনী অনুপ্রাণিত কিনা তার ব্যাপারে ইতিহাসবিদরা এখনো একমত হতে পারেননি। তবে ক্রিটিয়াস দাবি করেছিলেন যে, মহাজ্ঞানী সোলোনের কাছ থেকে তিনি এই গল্পটি জানতে পারেন। সোলোন ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের এথেন্সের বিখ্যাত নীতিনির্ধারক। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, তিনি যখন মিশরে যান, সেখানে প্রাচীন কিছু পুঁথি থেকে এথেন্স এবং আটলান্টিস সম্পর্কে জানতে পারেন।
তবে আরেক পক্ষ মনে করেন, প্লেটো প্রাচীন কিছু যুদ্ধের কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আটলান্টিসের এই কাহিনীটি রচনা করেন। অনেকেই মনে করেন, আটলান্টিস প্লেটোর কল্পনায় বোনা এক নগর সভ্যতা, যা তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তার ধ্বংস করেছেন। তবে, পৃথিবীর অধিকাংশ সংস্কৃতিতেই ‘হারানো সভ্যতার’ উপকথা প্রচলিত রয়েছে। তাই অনেক পণ্ডিতই এসব উপকথার ভিত্তি রয়েছে বলে মনে করেন। তাই কিছু গবেষক আটলান্টিসের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। আর তাই আটলান্টিস নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।
পিএসএন/এএপি
প্রকাশক ও সম্পাদক- আলি আবরার । নিরালা, খুলনা থেকে প্রকাশিত