
একাধিক গরম কাপড়, হাত মোজা, কানটুপি, মুখে মাস্ক পরে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে মানুষ। তবুও যেন শীতকে হার মানানো দায়। শুধুমাত্র আগুনের তাপেই যেন মেলে স্বস্তি। সারা দেশে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ার পাশাপাশি সূর্যের দেখা মিললেও কমেনি শীতের তীব্রতা। তাই তীব্র ঠান্ডাকে সঙ্গী করেই সারতে হচ্ছে দিনের সব কর্মকাণ্ড।
সোমবার (৯ জানুয়ারি) সকালে নাটোরের মাদ্রাসা মোড় এলাকায় সড়কের পাশে টায়ার, কাগজ, কাঠ জ্বালিয়ে দলবেঁধে ৮ থেকে ১০ জনকে আগুন পোহাতে দেখা যায়। গত চার দিনের তীব্র শীতে নাজেহাল হয়ে পড়েছে এ জেলার জনজীবন।
শ্রমিক রন্টু বলেন, ‘গত চার দিন ধরে একই রকম ঠান্ডা। মাঝখানে একদিন দুপুরে সূর্যের দেখা মিললেও ওই দিনও তাপমাত্রা সবচেয়ে কম ছিল। এমন শীতে গাড়ি চালানো কষ্টসাধ্য। হাত অবশ হয়ে আসলে গাড়ির হুইলও ঘোরানো যায় না।’
রিকশাচালক রিফাত মোল্লা বলেন, ‘গত কয়েক দিনে যা আয় হয়েছে তাতে রিকশার ভাড়াও উঠেনি। এমন ঠান্ডায় রিকশায় কোনো যাত্রী উঠতে চায় না, বাতাস লাগে তাই।’
রোববার আবহাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক মো. ছানাউল হক মণ্ডল জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলেও আগামী দুই-একদিন কুয়াশার আধিক্য থাকবে।
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে শরীয়তপুর-চাঁদপুর রুটের নরসিংহপুর ফেরিঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। রোববার রাত ১১টা ৫০ মিনিট থেকে এ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি নরসিংহপুর ঘাটের সহ-ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. ইকবাল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। নদীতে অনেক কুয়াশা। তবে মাঝ নদীতে কোনো ফেরি নোঙর করা নেই।’
শ্রীমঙ্গল
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। রোববার সকাল ৯টার দিকে তাপমাত্রা ১৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সকালের দিকে ঘন কুয়াশা পড়লেও দুপুরের দিকে সূর্যের দেখা মিলেছে। তবে সন্ধ্যায় আবারও হিমেল ঠান্ডা বাতাস জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। তাছাড়া হাওড় ও চা বাগান এলাকায় শীতের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান জানান, গত কয়েক দিন ধরে এ অঞ্চলে দিন ও রাতের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ছে। রোববার (৮ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে তাপমাত্রা বাড়লেও কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা কমেনি।
নেত্রকোনা
সারা দেশের মতো নেত্রকোনায়ও জেঁকে বসেছে শীত। বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। শীতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছে। চলাচল হয়ে পড়েছে কষ্টসাধ্য। রোববার বেলা ১১টা পর্যন্ত জেলায় তাপমাত্রা থাকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস।
জানা গেছে, খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে গ্রামের মানুষ। কনকনে বাতাসে ১০ উপজেলায় দরিদ্র লোকজন বেশি ভুগছেন। ঘন কুয়াশার কারণে সকাল থেকেই সূর্যের দেখা মেলেনি বললেই চলে। দুপুরের আগে উঁকি দেয় সূর্য। হাড় কাঁপানো শীতের কারণে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছেন না। শহরেও চলাচল অনেক কমে গেছে।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, ১০ উপজেলার শীতার্তদের মধ্যে ৪৪ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও দেয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গা
মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। শীতের তীব্রতা প্রতিদিন বাড়ছে, হ্রাস পাচ্ছে তাপমাত্রা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। রোববার সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, টানা কয়েক দিন মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে জেলায়। ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাসে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, জেলার ওপর দিয়ে রোববার থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে তাপমাত্রা। ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসের কারণে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে।
যশোর
যশোরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী কয়েক দিন এ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকবে। রোববার সকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে একথা বলা হয়েছে।
যশোর বিমানবাহিনীর আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহ ধরে যশোরের তাপমাত্রা নিম্নমুখী। রোববার তাপমাত্রা আরও নেমে এসেছে। সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এখানে রেকর্ড করা হয়েছে ৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশাচ্ছন্ন পুরো এলাকা; দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারের মতো। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে সব শ্রেণির মানুষ।
রাজশাহী
রাজশাহীতে তৃতীয়বারের মতো শুরু হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। গত কয়েকদিন তাপমাত্রা ওঠানামার পর আবারও এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, রাজশাহীর ওপর দিয়ে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিনটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। চলতি মৌসুমের ১৬ ডিসেম্বর ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এরপর তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে দুই অঙ্কের ঘরে যায়। প্রথম দফার মৃদু শৈত্যপ্রবাহ কেটেছে যাওয়ার পর ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ দিকে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরদিন কমে ২ জানুয়ারি ১১ দশমিক ডিগ্রি , ৩ জানুয়ারি ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ৪ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি, ৫ জানুয়ারি ১০ ডিগ্রি, ৬ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি ও শনিবার ৭ জানুয়ারি ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, সূর্যের দেখা মিললেও প্রখরতা থাকছে খুবই কম। এ কারণে দিনভরই শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক রাজিব খান জানান, গত কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা কেটে যাওয়ার করণেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। যদিও তাপমাত্রা ওঠানামা করছে, তারপরও শৈত্যপ্রবাহ কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে।
স্থানীয়রা বলছেন, শীতের সকালে কিংবা সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের সামনে মাফলার জড়ানো মুখগুলো দুই হাতে চায়ের কাপ ধরে উষ্ণতা নিচ্ছেন, আর চা পান করছেন। শীতের সকালে চায়ের কাপে মুখ না দিয়ে বাড়ি থেকে কাজে বের হচ্ছেন না অনেকে। শীতে এক কাপ চায়ের একটু উষ্ণতা নিতে পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে এখন শীতের সকালে যেন উপচেপড়া ভিড়!
মাসুদ নামে জেলা শহরের এক চা বিক্রেতা বলেন, দোকানে বেচা-বিক্রি সারা বছরই ভালো। তবে শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চায়ের বিক্রি-বাট্টাও বেড়েছে অনেক।
বরিশাল
বরিশালে শীতের তীব্রতা আরও বেড়েছে। জেলার শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে ৩৬টি বেডের বিপরীতে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ১২৩ জন। এ হাসপাতালে এক সপ্তাহে শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে এক শিশুর। আর এ বিভাগে শ্বাসকষ্টে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৩ হাজার ১৮৭ জন।
এ ছাড়া খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কুয়াশা ভেদ করে কাজে যেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষদের।
পিএসএন/এমঅাই