
হিমোফিলিয়া একটি রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ, যা বংশানুক্রমে পুরুষদের হয়ে থাকে। বংশগত রোগ এই রোগটিতে সাধারণত পুরুষরা আক্রান্ত হলেও নারীরা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করেন। বিশেষ ক্ষেত্রে নারীরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে না থাকলেও অন্য রোগের কারণে হিমোফিলিয়া রোগ দেখা দিতে পারে।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগ কর্তৃক বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব তথ্য জানান।
এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘এক্সসেস ফর অল: প্রিভেনশন অফ ব্লিডস এ্যাজ গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অফ কেয়ার’ অর্থাৎ রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ-সকলের নাগালে আসুক বিশ্বমানের সেবা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, হিমোফিলিয়া রোগে শরীরে আঘাত বা কেটে গেলে রক্ত জমাট বাধা প্রলম্বিত হয়। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে শরীরের কোনো জায়গায় আঘাত পেলে বা সামান্য কেটে গেলে ওই স্থান থেকে যে রক্তক্ষরণ হয়, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগীর ক্ষেত্রে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়। সাধারণত হিমোফিলিয়ার রোগীর সঙ্গে আত্মীয়ের (মামাতো, খালাতো বোনের) বিয়ে হলে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অনুষ্ঠানে হিমোফিলিয়ার সকল রোগী যেন সহজে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক, জরুরি চিকিৎসা এবং সুলভে ফ্যাক্টর, প্লাজমা এবং অন্যান্য চিকিৎসার উপকরণ পেতে পারেন সে ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানান হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দিন শাহ। একইসঙ্গে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের সমন্বয়ে কমপ্রিহেনসিভ হিমোফিলিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনসহ হিমোফিলিয়া চিকিৎসার সর্বাধুনিক সুবিধাদি সহজলভ্য করার ব্যাপারেও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান।
এসকল কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সহায়তা কামনা করে তিনি বলেন, সকল হিমোফিলিয়া রোগীর সহজ, সুলভ ও সময়মতো চিকিৎসা এদেশে দ্রুতই নিশ্চিত হবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, রোগের তীব্রতা বেশি হলে আঘাত ছাড়াই রক্তপাত হতে পারে এবং অস্থিসন্ধি বা গিরায় বা মাংসপেশিতে বারবার রক্তক্ষরণ হতে পারে। বারবার রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে গিরায় ক্ষয় এবং বিকৃতি দেখা দিতে পারে। এছাড়া স্পর্শকাতর অংশে যেমন মস্তিষ্ক, খাদ্যনালি, মেরুদণ্ড) রক্তক্ষরণ হলে জীবন বিনাশের বা স্থায়ী অক্ষমতার ঝুঁকি তৈরি হয়।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে হিমোফিলিয়া সম্পর্কে রোগী, রোগীর স্বজন, সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী এবং সর্বস্তরের জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম। হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুজাহিদা রহমান, রেসিডেন্ট ডা. তানভীর আহমেদ মেহেদী এবং ডা. মো. আব্দুল্লা আলমামুন সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেমাটোলজী বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহ উদ্দিন শাহ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রেসিডেন্ট ডা. মিলি দে ও ডা. কাজী ফজলুর রহমান।
বিশ্ব হিমোফিলিয়া ফেডারেশনের বার্ষিক সার্ভের (২০২০) তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি লক্ষ নবজাতক পুরুষ শিশুদের মধ্যে ২৪.৬ জন হিমোফিলিয়া এ এবং ৫ জন হিমোফিলিয়া বি রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে ৯.৫ জন হিমোফিলিয়া এ এবং ১.৫ জন হিমোফিলিয়া বি তে আক্রান্ত, শিশুরা তীব্র মাত্রার রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২২০০ এরও বেশি হিমোফিলিয়া রোগী রেজিস্টার্ড হয়েছেন। তবে ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
এ বিষয়ে বক্তারা জানান, হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে ফ্যাক্টর প্রদানের মাধ্যমে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ করা এবং তীব্র রোগীদের ক্ষেত্রে যেন রক্তপাত শুরু না হয় সেজন্য নিয়মিত ফ্যাক্টর প্রদানের ব্যবস্থা করা। হিমোফিলিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারের (এইচটিসি) মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া। গিরা ক্ষয় বা বিকৃত হয়ে গেলে ফিজিক্যাল থেরাপি বা সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি এ ধরনের রোগে আক্রান্ত রোগীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। এদেশে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী ফ্যাক্টরের সহজলভ্যতা কম এবং বাজার মূল্যের কারণে অনেক দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত রোগীর পক্ষে তা কিনে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।