আন্দোলনের তীব্রতায় বেগতিক হয়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ বিজয় অর্জন করেছে ছাত্র-জনতা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারে মনোনিবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তবে যাদের আত্মত্যাগে এই সফলতা, সেই হতভাগ্য মাঠের যোদ্ধারা এখন কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বিছনায়। বিশেষ করে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোরে) পা হারিয়ে চিকিৎসারত আছেন ১৪ জন। হাত হারিয়েছে একজন। অঙ্গ হারিয়ে অনিশ্চিত যাত্রায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা।
তাদের মধ্যে একজন রাজধানীর সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা নাদিম হোসেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সী এ কিশোর গত ২০ জুলাই চিটাগাং রোডে পুলিশের গুলিতে আহত হন। তার একটি পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। নাদিমের বাবা সিরাজ হোসেন হৃদযন্ত্রের জটিল রোগে আক্রান্ত। কাজ করতে অক্ষম বাবার অসুস্থতার কারণে সে পড়াশোনা করতে পারেনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ৫ জনের পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। পরিবারের থাকা খাওয়া ছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও যোগায় কিশোর নাদিম। কাজ করতো চিটাগাং রোডের একটি অ্যামব্রয়ডারি কারখানায়। প্রতিষ্ঠানের সামনেই গুলিবিদ্ধ হয় সে।
আব্বা অসুস্থ। আমার ছোটটা ক্লাস সিক্সে পড়ে, সবার ছোটজনের বয়স চার বছর। আমার ইনকামে পরিবার চলতো। অহন আর কেমনে চলবে। অনেকে দুই-এক হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। অনেকে নকল পা লাগিয়ে দেবে বলেছে।
—গুলিবিদ্ধ ১৬ বছর বয়সী নাদিম হোসেন
ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশার কথা জানিয়ে ঢাকা মেইলকে এই কিশোর বলেন, ‘আব্বা অসুস্থ। আমার ছোটটা ক্লাস সিক্সে পড়ে, সবার ছোটজনের বয়স চার বছর। আমার ইনকামে পরিবার চলতো। অহন আর কেমনে চলবে। অনেকে দুই-এক হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। অনেকে নকল পা লাগিয়ে দেবে বলেছে।’
ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের অপর রোগী ১৯ বছর বয়সী রাকিব। কুমিল্লার মুরাদনগর থানার এই বাসিন্দা যাত্রাবাড়ী চিটাগাং রোডে একটি সেলুনে কাজ করতো। গত ২০ জুলাই পায়ে গুলি লাগে তার। রাকিবের মা রিনা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার ছেলে তো কোনো রাজনীতি করতো না। সে সেলুনের কাজ শিখতে ঢাকায় আসছে। তাকে কেন গুলি করলো। আমরা গরিব মানুষ, চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছি না। এখন হাসপাতাল থেকে ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলের ভবিষ্যত কি হবে?
নাদিম ও রাকিবের মতো ১৪২ জন কিশোর ও বিভিন্ন বয়সী মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে নিটোরে। হাসপাতালটির নিচতলার ক্যাজুয়ালিটি-২ এর ৫৬টি বেডের সব কয়েকটিতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা। পা কেটে ফেলা ছাড়াও গুলি লেগে হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে অনেক রোগীর। ফলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাদের। আর এই দীর্ঘ চিকিৎসার খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আহতদের পরিবার।
আমার ছেলে তো কোনো রাজনীতি করতো না। সে সেলুনের কাজ শিখতে ঢাকায় আসছে। তাকে কেন গুলি করলো। আমরা গরিব মানুষ, চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছি না। এখন হাসপাতাল থেকে ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলের ভবিষ্যত কি হবে?
—গুলিবিদ্ধ কিশোর রাকিবের মা রিনা আক্তার
নিটোরের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডের জি-৬ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. সিফাত। গুলিতে তার ডান পায়ের হাঁটুর জয়েন্টের হাড় ভেঙে যায়। গত ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ এই কিশোর জানায়, ঘটানার দিন সন্ধ্যার পর সে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় অবস্থান করছিল। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ একদল পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে আগায়। এ সময় ভয় পেয়ে তারা দৌড়াতে শুরু করে। দৌড়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর তার পায়ে গুলি লাগলে সে পড়ে যায়। ওই সময় তার সাথে থাকা বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে মিরপুরের আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিটোরে পাঠানো হয়।
সিফাতের মা জানান, তার ছেলের হাঁটুর জয়েন্টের হাড় ভেঙে গেছে। গত একমাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সুস্থ হতে আরও কয়দিন লাগবে তা জানা নেই। প্রতিদিন বাসায় যাওয়া-আসা, খাবার ও চিকিৎসা ব্যয়সহ এখন পর্যন্ত তাদের ৭৫ হাজার টাকার অধিক খরচ হয়েছে। এখন হাসপাতালের পক্ষ থেকে পরীক্ষাসহ সকল চিকিৎসা সামগ্রী বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে তাদের যা খরচ হওয়ার হয়ে গেছে।
৪২ জন কিশোর ও বিভিন্ন বয়সী মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে নিটোরে। হাসপাতালটির নিচতলার ক্যাজুয়ালিটি-২ এর ৫৬টি বেডের সব কয়েকটিতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা। পা কেটে ফেলা ছাড়াও গুলি লেগে হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে অনেক রোগীর। ফলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাদের। আর এই দীর্ঘ চিকিৎসার খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আহতদের পরিবার।
নিটোরে চিকিৎসায় অবহেলা ও অর্থ আদায়
এদিকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় অবহেলা ও সেবার বিপরীতে টাকা গ্রহণ করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সেবা দেওয়ায় ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলনে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় অবহেলা ও দেরি করা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসায় (অপারেশন থিয়েটারে সঠিক সময়ে আনা নেওয়া, অপারেশন করা ও আহতদের ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে) অনাকাঙ্ক্ষিত দেরি করা হচ্ছে। এমনকি সরকার আহতদের সমস্ত ব্যয় বহন করার ঘোষণা দেওয়া হলেও সরকারি নির্দেশ অমান্য করে চিকিৎসা সেবা প্রদানের (যেমন হাতে বা পায়ে রড লাগানো, রক্ত সরবরাহ, ক্ষতস্থানে ড্রেসিং ইত্যাদি) ক্ষেত্রে বিভিন্ন অজুহাতে আহতদের চিকিৎসা সেবার বিপরীতে টাকা গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আবশ্যিকভাবে বিরত থাকতে হবে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা ও ব্যবস্থাপনায় নিটোর হাসপাতালের পরিচালকসহ ৫ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এ হাসপাতালের এ-ওয়ান, বি-ওয়ান ও ক্যাজুয়ালটি এই তিন ওয়ার্ডকে আহতদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিট করা হয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন। সহযোগিতার অংশ হিসেবে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলকারী সমন্বয়কদের সঙ্গে মিলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে আহতের চিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছি। এখানে ১৪২ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন শিক্ষার্থী। সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ১৩ জনের পা কাটা হয়েছে। এক জনের হাত কাটা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমরা দেব। এমনকি কোনো রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হলে সেটাও করা হবে।
—সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসারত আহতদের দেখতে প্রতিদিনই হাসপাতালে ভিড় করছেন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। এর মধ্যে সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আহত ১৪২ জনকে চিকিৎসা সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
এ বিষয়ে ১৮ আগস্ট নিটোরে উপস্থিত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন। সহযোগিতার অংশ হিসেবে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলকারী সমন্বয়কদের সঙ্গে মিলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে আহতের চিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছি। এখানে ১৪২ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন শিক্ষার্থী। সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ১৩ জনের পা কাটা হয়েছে। এক জনের হাত কাটা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমরা দেব। এমনকি কোনো রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হলে সেটাও করা হবে।
এ বিষয়ে সংগঠনটির উপ মহাব্যবস্থাপক আশা পাল বলেন, আমরা নিটোরে চিকিৎসাধীনদের ওষুধ ও আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছি। আহতদের অবস্থা জটিল। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন। আমরা এখন পযন্ত ৩০ লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেছি।