ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউরোপের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা এখন তীব্র হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকটি কিয়েভের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই বৈঠকটি ইউক্রেনের জন্য বিপর্যয়কর ছিল, এবং এর পরেই যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করার চেষ্টা করছে। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য অনেক বাধা রয়েছে, বিশেষ করে রাশিয়ার অটুট শত্রুতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তি।
এখন প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়ার অব্যাহত শত্রুতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অনিশ্চয়তার মধ্যে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা কি আসলেই সম্ভব? এবং যদি তা সম্ভব হয়, তবে তা কিভাবে হতে পারে?
ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই যুদ্ধ শেষ করতে চাইলেও তারা শান্তি চুক্তির শর্তে একমত হতে পারছে না। রাশিয়া এখনও ইউক্রেনের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে চায় এবং তাদের অনেক এলাকা দখল করে রেখেছে। রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য হল, ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগ না দিতে পারে। অন্যদিকে, ইউক্রেন তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে লড়াই করছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে থাকতে চায়, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন থাকে। কিংস কলেজ, লন্ডনের ইমেরিটাস অধ্যাপক স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যান বলেন, “রাশিয়া যা চায়, সেটা যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারে না এবং ইউক্রেন সেটা মেনে নেবে না।” এর ফলে, শান্তির জন্য একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তি কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেনের ভেতরেও কিছুটা নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। তারা যে এলাকায় যুদ্ধ চলছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সীমান্ত ভাগাভাগি করার জন্য কিছুটা সমঝোতা করতে ইচ্ছুক, তবে এর বেশি কিছু মেনে নেওয়া তাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক হবে। ইউক্রেনের মানুষ রাশিয়ার অধীনে থাকতে চায় না, এবং তারা তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়। ইউক্রেনের সমাজে রাশিয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা।
যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ত্যাগ করে, তবে কী হবে? গত শুক্রবার ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার পর, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্ক আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যেটি ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র সহায়তা প্রদান করেছে, এবার হয়তো এই সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা অনুমোদিত ছিল, কিন্তু গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সেই সহায়তা বাতিল করা হতে পারে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হলে, যুদ্ধক্ষেত্রে তারা যে সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে, তার প্রায় ২০ শতাংশ আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্রগুলোও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রের অভাবে, ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে, তবে এটি ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা যদি বন্ধ হয়, তাহলে তা ইউরোপ পূরণ করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহগুলো ইউরোপের পক্ষে প্রদান করা কঠিন হবে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানি তাদের টরাস ক্ষেপণাস্ত্র দিতে রাজি হয়নি এবং ফ্রান্সের কাছে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, স্টারলিংক স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা ইলন মাস্কের অধীনে চলে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা ইউরোপ সহজেই প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ৩৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সমরাস্ত্র কেনার জন্য ইউক্রেনকে আরও ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ইউরোপের সমরাস্ত্র সহায়তা মোট ৬২ বিলিয়ন ইউরো, যা ৬৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেন থেকে সরে যায়, তাহলে ইউরোপকে দ্বিগুণ অর্থ ঢালতে হবে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
বর্তমানে, ইউরোপও ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে একটি শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠনের কথা ভাবছে, তবে এর জন্য যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন হবে। রাশিয়া ইতোমধ্যে বলেছে যে, তারা ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর শান্তিরক্ষা বাহিনীকে গ্রহণ করবে না, তবে যদি এসব বাহিনী ইউক্রেনের অন্য অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়, তখন রাশিয়া এতে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু, এমন শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে বড় ধরনের সমঝোতা প্রয়োজন হবে, যা কঠিন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ওয়াশিংটন সফর করে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তবে সে বৈঠকে তিনি তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেছেন, “জেলেনস্কির হাতে আর কোনো কার্ড নেই।” ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির তিক্ত সম্পর্ক, ইউক্রেনের জন্য শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানোর সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে দিয়েছে।
এদিকে, ইউরোপীয় নেতারা যদি এই পথে এগোতে চান, তাদেরকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যাপারে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু ইউরোপ কি এতদূর এগোতে প্রস্তুত? ইউরোপের নিরাপত্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে ছিল, তবে বর্তমানে তা অনিশ্চিত। বিশেষত, ট্রাম্পের সময় থেকেই ন্যাটো ও ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কমে গেছে।
এটি স্পষ্ট যে, কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার অগ্রাধিকার পরিবর্তন করছে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। ইউরোপকে এখন নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং সম্ভাব্য উত্তেজনা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান