গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজার বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে ইসরাইল আনুমানিক ৭০ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করেছে। ধ্বংসাত্মক হামলায় ১৫ হাজার শিশুসহ প্রায় ৩৭ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিখোঁজ আরও প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে নিহতের এই সংখ্যাগুলোর কোনো পাত্তাই থাকবে না। কারণ, সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সতর্ক করে বলেছে যে, মধ্য জুলাই নাগাদ গাজায় ১ মিলিয়নের বেশি (মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি) মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যেতে পারে।
এমন ভয়াবহ বিশ্লেষণের ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর সর্বশেষ হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিকার অর্থে কোনো হস্তক্ষেপই করছে না। ফলে, বোমা হামলার প্রত্যক্ষ ফলাফলের চেয়েও ইসরাইলের জোরপূর্বক অনাহারে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে। এটা পরিষ্কার হওয়া জরুরি যে, এই দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি মানবসৃষ্ট। ফলে, এজন্য কারা দায়ী সেটা চিহ্নিত করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং চারিদিকে এ ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনাও হচ্ছে। গাজায় অর্থপূর্ণ যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ পশ্চিমা মিত্ররা ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তেল আবিবকে উপত্যকার ফিলিস্তিনি জনগণকে অনাহারে মেরে ফেলার সবুজ সংকেতও দিয়েছে। যুদ্ধ কিংবা সংঘাতের সময় ক্ষেত্র বিশেষ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক অনাহারে রাখার বিষয়টি ভিন্ন।
মূলত, আধিপত্য বিস্তার লাভের উদ্দেশ্যে কোনো জনপদের লোকজনকে বিতাড়িত করার জন্য ঔপনিবেশিক শক্তি এই কৌশল রুটিনমাফিক কাজে লাগিয়ে থাকে। গাজায় বর্তমানে বেসামরিক লোকজনকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পেছনে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণ যুক্ত রয়েছে। যার সবগুলোই ইসরাইলের দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও জীবিকার ওপর আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। গাজায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে বাধাদানের পাশাপাশি কি কি জিনিস ঢুকতে দেওয়া হবে কিংবা হবে না সেজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরির মাধ্যমে ধাপে ধাপে বাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসরাইল অব্যাহতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে যাতে উপত্যকাটিতে দুর্ভিক্ষ ত্বরান্বিত হয়।
আমরা মনে করি, বেসামরিক স্থাপনায় হামলার সঙ্গে ফিলিস্তিনের জনগণের কাছে খাদ্য সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ধ্বংস করা ইসরাইলি বাহিনীর ইচ্ছেকৃত কৌশল এবং এর স্বপক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। পানি স্যানিটেশন স্টেশন, ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি, ত্রাণ গুদাম, বেকারি এবং আটা-ময়দার মিলসহ সবকিছুই ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলার নিয়মিত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অবকাঠামোর পাশাপাশি যারা জীবন রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীদের চিহ্নিত করে হামলা করা হচ্ছে।
অতএব, মানবসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষকে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। বরং অবশ্যই এটিকে কয়েক দশকের ঔপনিবেশিক চর্চার প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। যার মূল লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ডে অবস্থান এবং ঐতিহাসিক উপস্থিতিকে নির্মূলের চেষ্টা।
প্রকৃতপক্ষে, ২০০৭ সালে গাজার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের পর থেকেই ইসরাইল এমন এক নীতি গ্রহণ করেছে যার মধ্যদিয়ে সেখানে জোরপূর্বক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা হয়েছে। কয়েক স্তরের এসব নীতির মধ্যে রয়েছে- কোনো খাদ্য গাজায় ঢুকবে কিংবা কোনগুলো ঢুকবে না এমন নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যের ওপর নজরদারি করা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অবরোধ যুদ্ধ অবৈধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসরাইলের এই অবরোধ আরোপের অর্থই হলো- দখলদার রাষ্ট্র কর্তৃক গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিদিনের ক্যালোরির চাহিদার ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণে, গাজাবাসীর কাছে মাংস, দুধ, ফলমূল এবং শাকসবজিও বিলাসী পণ্য হয়ে ওঠে।
অক্সফাম প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান গণহত্যার কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে উত্তর গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের গড়ে দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা ২৪৫-এ নেমে এসেছে। তবুও ইসরাইল যদি আজকেই সীমান্ত ক্রসিংগুলো খুলে দেয় তাহলে যারা খাবারের জন্য গাজার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে তাদের হাতে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই খাবার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কারণ, যেসব ক্রসিং দিয়ে মানবিক ত্রাণ সহায়তা গাজায় প্রবেশ করে সেগুলোর কোনটি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু দখলদার বাহিনী উদ্দেশ্যমূলক ক্রসিংগুলো বন্ধ করে রেখেছে।
ফলত ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করেছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গ্যালান্ট হলেন সেই ব্যক্তি যিনি, গেলো বছর অক্টোবরে গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার সময় ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখার ইসরাইলি উদ্দেশ্যের কথা খুব পরিষ্কার করেই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সেখানে বিদ্যুৎ, খাবার, জ্বালানি কিছুই থাকবে না, সবকিছুই বন্ধ। আমরা মনুষ্য জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করছি এবং আমরা সে অনুযায়ীই কাজ করছি।’
আজ অবধি, এর বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোনো সরকারই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং উল্টো তারা এসব অপরাধে সহায়তা এবং প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একদিকে গাজায় অপর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ, অন্যদিকে তাদের সুরক্ষিত ইসরাইলি মিত্রদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য বজায় রাখার মধ্যদিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ সংহারের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে, এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ব্রিটেনের আগামীর প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টার্মারসহ আন্তর্জাতিক মিত্ররা গাজায় ইসরাইলের পানি সরবরাহ বন্ধের বিষয়ে দ্রুতই সাড়া দিয়ে বলেছেন যে, এটি করার অধিকার তার রয়েছে।
এই হলো ইসরাইলি রাষ্ট্র যে কিনা একটি দুর্ভিক্ষের উৎপাদন করতে পারে এবং এ যাবৎকালে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক শিশুকে অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এজন্য সে দায়মুক্তি লাভের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের সৌজন্যে দীর্ঘ প্রায় আট মাসের বেশি সময় ধরে একটি বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর বোমাবর্ষণ সহ্য করার পর তাদেরকে জোরপূর্বক অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যে ক্ষত/দাগ তৈরি করেছে তা কখনোই মেরামতযোগ্য নয়। তাই, অতি দ্রুত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আবশ্যক।